লোক ঢোকানোর রাজনীতিই ডোবাচ্ছে নাব্যতাহীন ডককে
লদিয়া থেকে এবিজি-বিদায়ে রাজ্যের শিল্প পরিবেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা তো রটে গিয়েছেই। কিন্তু সেই স্পষ্ট বার্তার অন্তরালে থেকে যাচ্ছে অন্য প্রশ্নও। লক্ষ্মণ শেঠদের উত্তরাধিকার বহন করতে গিয়েই কি আরও বিপর্যয় ডেকে আনছেন শুভেন্দু অধিকারীরা?
বস্তুত, হলদিয়া বন্দরের উপযোগিতা নিয়েই দীর্ঘ কাল ধরে প্রশ্ন রয়েছে শিল্প ও বাণিজ্য মহলে। নদীনির্ভর এই বন্দরে বড় জাহাজের প্রবেশে এমনিতেই অসুবিধা রয়েছে। ছোট জাহাজে পণ্য এলেও তা খালি করতে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিলে তবেই এই ধরনের বন্দরের কর্মক্ষম থাকা সম্ভব।
আবার আধুনিক প্রযুক্তির আগমন মানেই কর্মীর সংখ্যায় সঙ্কোচন। আর ঠিক এই জায়গাতেই চাপ সৃষ্টির রাজনীতি চালিয়ে হলদিয়ার জীবন কঠিন করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে লক্ষ্মণবাবুদের বিরুদ্ধে। বাড়তি লোক নেওয়ার দাবিতে তাঁরা সুকৌশলে রাজনীতি চালিয়েছেন, তৃণমূলের জমানায় তা আরও বেআব্রু চেহারা নিয়েছে তফাত বলতে এইটুকুই!
হলদিয়ায় বন্দর করার কোনও যুক্তি ছিল না বলেই মনে করে শিল্প মহলের একাংশ। তার উপরে লক্ষ্মণবাবুদের জবরদস্তির রাজনীতি নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিল বন্দরে কর্মরত সংস্থাগুলির এমন অভিযোগও বিরল নয়। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “এমনি এমনি তো হলদিয়ায় লক্ষ্মণ-সাম্রাজ্যের পতন হয়নি! আজ যাঁরা হলদিয়া নিয়ে এত কথা বলছেন, তাঁরা নিজেদের লোক ঢোকাতে সেখানে কী করেছিলেন? আধুনিকীকরণের কাজ হলদিয়ায় মসৃণ ভাবে হতে দিয়েছিল সিটু?”

রাজনৈতিক পরম্পরা? লক্ষ্মণ শেঠ ও শুভেন্দু অধিকারী।
লক্ষ্মণবাবুর অবশ্য দাবি, তিনি হলদিয়া বন্দরের আধুনিকীকরণ বা মেকানাইজেশনের বিরোধিতা কখনও করেননি। তাঁর যুক্তি, বন্দরের বার্থে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে মাল ওঠা-নামা হলে জাহাজ পিছু কম সময় লাগে। তাতে বেশি কার্গো ঢুকতে পারে। আর যত বেশি সংখ্যায় কার্গো ঢুকবে, তাকে ঘিরে বিভিন্ন স্তরে লোকের প্রয়োজনীয়তাও থাকবে। এই সহজ সত্য তাঁরা বুঝতেন বলেই তমলুকের প্রাক্তন সাংসদের দাবি।
ঘটনা হল, কলকাতা ও হলদিয়া দুই ডকই নদীনির্ভর। বড় জাহাজ ঢোকা সেখানে সমস্যা। স্যান্ডহেডে জাহাজ রেখে মাল নিয়ে আসতে হয় ডকে। অথচ আধুনিক আন্তর্জাতিক ব্যবসায় এখন পণ্যবাহী বড় জাহাজেরই চল। পরিভাষায় যাকে ভিএলসিসি বলে। হলদিয়ায় এই ধরনের বড় জাহাজ আসার সমস্যার জন্যই ইন্ডিয়ান অয়েল তেলবাহী কার্গো নিয়ে চলে গিয়েছিল পারাদীপে। সেখান থেকে পাইপলাইনে তেল পাঠানোর ব্যবস্থা হয়েছিল হলদিয়া সংশোধনাগারে। এই উদাহরণ দিয়েই বাম জমানার শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন মেনে নিচ্ছেন হলদিয়ার সমস্যার কথা। তাঁর কথায়, “হলদিয়ায় নাব্যতার সমস্যা তো ছিলই। সেই জন্যই বহু আলাপ-আলোচনা করে দিল্লিকে বোঝাতে পেরেছিলাম, আমাদের বিকল্প হিসাবে গভীর সমুদ্র বন্দর দরকার।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হয়েছিল। সেই কাজে এগোনোও হয়েছিল। কুলপিতে বেসরকারি বন্দরের জন্যও উদ্যোগী হয়েছিলাম। কেউ কেউ উৎসাহও দেখিয়েছিলেন। সব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু চেষ্টা করেছিলাম।”
নিরুপমবাবু, লক্ষ্মণবাবুদের আরও বক্তব্য, বন্দর কী ভাবে চলবে, তা শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের উপরে নির্ভর করে। তৃণমূল ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকারে যাওয়ার পরে এবং জাহাজ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী পাওয়ার পরে বন্দরের স্বার্থে কী কী করেছিল, তার খতিয়ান সেই জন্যই নেওয়া দরকার বলে সিপিএম নেতৃত্ব মনে করেন। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য নিরুপমবাবুর বক্তব্য, “নাব্যতার সমস্যা, ড্রেজিং এ সবের জন্য আমাদের যা যা করার, সবই করেছি। হলদিয়ায় আধুনিকীকরণের বিরোধিতা তো কখনও করিনি! ওখানে মেকানাইজেশনের কোনও বিরোধিতা আমাদের তরফে ছিল না। আমরা এর প্রয়োজনীয়তা বুঝেছিলাম।”
কংগ্রেস, তৃণমূল এবং শিল্প মহলের একাংশের অবশ্য অভিযোগ, আধুনিকীকরণের সঙ্গে সিটুর স্বার্থের সংঘাত বেধেই হলদিয়ার সঙ্কট ঘনীভূত হয়েছিল। বাড়তি লোকের সমস্যা পরবর্তী কালে তৃণমূল নিজের মতো সামলাতে গিয়েছে এবং তাতে আরও সমস্যা হয়েছে। হলদিয়ায় সিটুর এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা লক্ষ্মণবাবুর মত অবশ্যই ভিন্ন। তাঁর দাবি, “আমি সর্বান্তকরণে মেকানাইজেশনের প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেছিলাম। সেটা এবিজি-র জন্য নয়। বন্দরের স্বার্থের জন্য।”
ঘটনাপ্রবাহ অবশ্য বলছে, ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব বন্দরের ভাল-মন্দের চেয়েও বেশি মাথা ঘামিয়েছেন নিজেদের ‘লোক নেওয়া’ কতটা হচ্ছে, তার দিকে। তাদের দাপট থাকার সময় সিটুও হলদিয়ায় তা-ই করেছে। সিটু নেতৃত্ব নিজেরাই মানছেন, এক তৃণমূল সাংসদের মালিকানা আছে, এমন একটি মাল খালাসকারী সংস্থা লোক ছাঁটাই করার পরে তাঁরা ওই শ্রমিকদের হয়ে আসরে নামেন। চুক্তি করে সেই শ্রমিকদের এবিজি-তে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে অগ্রণী ছিলেন তাঁরাই। এখন আবার শুভেন্দুরা এবিজি-র শ্রমিক ছাঁটাইয়ের বিরোধিতা করতে ময়দানে অবতীর্ণ। যেখানে সিটুর পাল্টা যুক্তি, এবিজি-কে ৯ মেট্রিক টন মাল খালাস করতে দিলে ওই শ্রমিকদেরও তারা কাজে লাগাতে পারত। এতেই বোঝা যায়, কোন সংস্থা চাহিদামতো কত লোক নেবে বা রাখবে, তা বেছে নেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা সংস্থা কর্তৃপক্ষের হাতে দিতে বাদ সেধেছে রাজনীতি। আগে ছড়ি ঘুরিয়েছেন লক্ষ্মণবাবুরা। এখন শুভেন্দুরা।
বন্দর-বিতণ্ডা

পার্থ চট্টোপাধ্যায় (রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী)

এবিজি কর্তৃপক্ষ
ওদের চিঠি দিয়ে ডেকেছিলাম। আসেনি।
বন্দরের ব্যাপার, বন্দরই বুঝুক।
রাজ্যকে চিঠি দিয়েছি। শিল্পমন্ত্রীকেও
জানিয়েছি। জুটেছে উপেক্ষা।
ওরা হলদিয়ায় লগ্নি করেনি। চলে গেলে অন্যে
পণ্য খালাস করবে। শিল্প-ভাবমূর্তির ক্ষতি হবে না।
হলদিয়ায় দেড়শো কোটি টাকা ঢেলেছি।
ফরাসি সংস্থাও সহযোগী।
ওরা শিল্প নয়, ঠিকাদার সংস্থা।
অন্য জায়গায় ওদের রেকর্ড দেখুন।
বিশাখাপত্তনম-তুতিকোরিনে বন্দর নির্মাণে ১৪০০ কোটির প্রকল্প করছি। বিভিন্ন বন্দর আধুনিকীকরণে আমাদের কয়েকশো কোটির কাজ চলছে।
খবর পাচ্ছি, শ্রমিকদের পাওনাগণ্ডা মেটায়নি। পিএফ, ইএসআইয়ের সব টাকা মিটিয়েছি।
লক্ষ্মণবাবুর বক্তব্য, “হলদিয়ায় ছোট কার্গোয় মাল আনতে হয়। মাল খালাস করতে বার্থে তিন-চার দিন কার্গো দাঁড়িয়ে থাকলে ডিটেনশন চার্জ দিতে হয়। তার চেয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে তাড়াতাড়ি মাল খালাস করলে বেশি কার্গো ঢুকবে এবং তাতেই শ্রমিকের লাভ।” লক্ষ্মণবাবুর অভিযোগ, রাজ্যে তৃণমূলের দেড় বছরের জমানায় হলদিয়ায় পাঁচ হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।
লোক ঢোকানোর রাজনীতি করে বন্দরের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়ার অভিযোগ এত দিন লক্ষ্মণবাবুদের বিরুদ্ধে তুলে এসেছেন তৃণমূলের নেতারা। এখন আবার সিপিএমের এক রাজ্য নেতা বলছেন, “আগে হলদিয়ায় ছিল ইউনিয়ন-রাজ। কিন্তু এখন এসেছে গুন্ডারাজ! আগেকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বন্দরের বিভিন্ন কাজে ১০০ জনের মধ্যে গড়ে ৭০ জনই হয়তো সিটুর লোক ছিল। সংস্থাগুলির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পথেই তাদের কাজে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হত। এখন তো গুন্ডামি হচ্ছে!”
নাব্যতাহীন এক ডকের হাল অর্থনীতির যুক্তিতেই সঙ্গিন। রাজনীতির টানাপোড়েন তাকে আরও ডকে তুলছে! লক্ষ্মণদের উত্তরাধিকার এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন শুভেন্দুরা!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.