বিশ্বাসে মিলায় বস্তু...এবং মৃত্যুও!
সংগ্রহে হাতির লেজের নিতান্তই একটা চুল থাকলে আর যাই হোক ‘অপঘাতে মৃত্যু’ নেই।
বুনো হাতির কান এক বার ধরতে পারলে মনস্কামনা পূর্ণ হবেই কিংবা ‘হাতি ঠাকুরের’ পিঠে উঠে দু’দিকে পা ঝুলিয়ে বসতে পারলে লাখপতি হওয়া ঠেকায় কে!
রাঢ়বঙ্গে হাতি বিষয়ক এমন কুসংস্কারের তালিকা দীর্ঘ। আর সেই ‘বিশ্বাস’ থেকেই হস্তি-সংস্পর্শে আসতে গিয়ে প্রতি বছর বেড়ে চলেছে মৃত্যুর পরিসংখ্যান। গত এক বছরে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুরে জঙ্গল ঘেঁষা গ্রাম-গঞ্জে এমনই অজস্র গ্রামীণ সংস্কারের ‘শিকার’ ১৯ জন গ্রামবাসী। হাতির পিঠে উঠতে সফল না হলেও দলমার দামালদের পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু হওয়ায় বন দফতরের কাছ থেকে তাঁদের নিকটজনেরা লক্ষ টাকা অনুদান পেয়েছেন! তবে সকলে নয়। সেখানেও বাধ সেধেছে রাজ্য সরকারে হালের ট্রেজারি-বিধি। বছর ঘুরে গেলেও ট্রেজারি ঘুরে সেই পাওনা টাকা জোটেনি ওই তিন জেলার অধিকাংশেরই।
বর্ষা-অন্তে লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের দলমা পাহাড় থেকে নেমে আসে হস্তিকুল। আশির দশকের মধ্যভাগ থেকেই বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর, বড়জোড়া কিংবা পশ্চিম মেদিনীপুরের অন্তত তিনটি মহকুমার বাসিন্দারা তাঁদের মরসুমি অতিথিদের সান্নিধ্য পেয়ে আসছেন। খাবারের খোঁজে দলমার দলটি কখনও বা মুখ ফেরায় দক্ষিণ বাঁকুড়া হয়ে পুরুলিয়ার দিকেও। সম্প্রতি তাদের গতিবিধি ছড়িয়েছে দামোদর পেরিয়ে দূর্গাপুর শিল্পাঞ্চল লাগোয়া বর্ধমান জেলাতেও। |
বুনো হাতির লেজ ধরে টান! শনিবার বিষ্ণুপুরের উলিয়াড়ায় শুভ্র মিত্রের তোলা ছবি। |
প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে দলমার হাতিদের আসা-যাওয়া, তাদের স্বভাব-চরিত্র, পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে সম্যক একটা ধারণাও তৈরি হয়েছে এই এলাকার অন্তত সাড়ে তিনশো গ্রামের বাসিন্দাদের। পরিচিত এক হস্তি বিশেষজ্ঞের কথায়, “বছরের একটা বড় সময় ওই এলাকার গ্রামবাসীদের জীবনের হাসি-কান্নাও হাতির আনাগোনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। তবুও তাঁদের কৌতূহল যেন মেটে না।”
আর তাই জঙ্গল থেকে ঐরাবতেরা লোকালয়ে বের হলেই তাদের ঘিরে ভিড় জমে যায় নিমেষে। শনিবার তেমনই এক ঘটনার সাক্ষী থাকল বিষ্ণুপুরের উলিয়ারা। গত সেপ্টেম্বরে স্থানীয় এলাকার একটি ক্যানালে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছিল দলমার দু’টি হাতি। বনকর্মীদের শুশ্রূষায় তারা এখন আশপাশের জঙ্গলে ঠাঁই গেড়েছে। এ দিন তাদের একটি জঙ্গল থেকে লোকালয়ে পা রাখতেই তাকে ঘিরে শুরু হল ছবি তোলা, ছুঁয়ে দেখা। ক্রমে চড়তে থাকল উৎসাহ। কেউ তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। কোনও বীরপুঙ্গব টেনে ছিঁড়ল তার লেজের চুল।
বন দফতরের এক কর্তার কথায়, “হাতি দেখলেই শিশু-কিশোর থেকে বয়ঃবৃদ্ধ সকলেরই যেন কুসংস্কার মাথা চাড়া দেয়। যেন তেন প্রকারে তাঁদের অনেকেই তখন হাতির কাছে ঘেঁষতে চান।” অনিবার্য মৃত্যুর কথা বেমালুম ভুলে তাঁদের কেউ অতি সাহসী হয়ে হাতির লেজের চুল সংগ্রহ করতে তৎপর হয়ে পড়েন। কেউ বা কানের স্পর্শ পেতে চান। বনকর্তাদের অভিজ্ঞতা হল, হাড়িয়া কিংবা দিশি মদের নেশায় ‘বাস্তববোধ’ হারিয়ে কেউ বা চান হাতির পিঠে উঠতে।
হারানো সেই ‘বাস্তববোধ’ তাঁদের কবে ফিরবে? |