উন্নয়নের কাজে কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলেছে রাজ্য সরকার। দিল্লির সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরে কেন্দ্র-বিরোধী সেই অভিযোগ ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। অথচ এলাকা উন্নয়নে নিজেদের তহবিলের টাকাই খরচ করতে পারছেন না রাজ্যের অনেক বিধায়কই! এঁদের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের এক ডজন মন্ত্রীও রয়েছেন।
নিজেদের এলাকা উন্নয়নের জন্য বিধায়কেরা বছরে ৬০ লক্ষ করে টাকা পান। গত বছরের মে মাসে রাজ্যে ‘পরিবর্তনে’র পর এ পর্যন্ত বিধায়ক এলাকা উন্নয়ন তহবিলে মোট ২২৬ কোটি ২০ লক্ষ টাকা মঞ্জুর করেছে রাজ্য সরকার। কিন্তু রাজ্যের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দফতরের দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত রাজ্যের ২৯৫ জন বিধায়ক (এক জন মনোনীত) খরচ করতে পেরেছেন মাত্র ৪৮ কোটি ২৮ লক্ষ ১৮ হাজার টাকা, শতাংশের হিসাবে যা ২১.৩৪।
রাজ্য উন্নয়ন ও পরিকল্পনা দফতরের এক কর্তা জানান, সাধারণত ছ’মাস অন্তর দুই কিস্তিতে টাকা দেওয়া হয়। প্রথম কিস্তির টাকার অর্ধেক খরচের ‘ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট’ বা ‘কাজ শেষের শংসাপত্র’ পেলে পরের কিস্তি মঞ্জুর করা হয়। কিন্তু গত বছর নতুন সরকার হওয়ায় পর জুলাই ও সেপ্টেম্বর মাসেই মোট ৬০ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে বিধায়কদের। |
বিধায়ক
তহবিল |
দেড় বছরে মঞ্জুর
২২৬.২০ কোটি |
খরচ হয়নি
১৭৭.৯২ কোটি |
সাংসদ তহবিল
৩ বছরে খরচ হয়নি
১৩৪.৯০ কোটি |
খরচ করেছেন |
১৩.৩৩% |
০% |
০% |
২২.০৭% |
|
|
|
|
বিষয়টা দেখতে
হবে
সুব্রত মুখোপাধ্যায় |
পুরসভার
জন্যই
বিলম্ব
পূর্ণেন্দু বসু |
স্কুলকে টাকা।
একটু সময় লাগল
মানস ভুঁইয়া |
জেলা প্রশাসনের
গাফিলতিতে দেরি
উপেন কিস্কু |
|
ফল কী দাঁড়িয়েছে? ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী রাজ্য সরকারি তথ্যই বলছে: ১০০ জন বিধায়ক ৬০ লক্ষ টাকার অর্ধেক খরচেরও ‘ইউসি’ দিতে পারেননি এখনও। এঁদের মধ্যে রয়েছেন রাজ্যের হেভিওয়েট মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, পূর্ণেন্দু বসু, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, গৌতম দেব, জাভেদ খান, রচপাল সিংহ-সহ বর্তমান মন্ত্রিসভার এক ডজন সদস্য। সুব্রতবাবু হিসেব দিয়েছেন ৮ লক্ষ টাকা খরচের, জ্যোতিপ্রিয় ২৬.১৫ লক্ষ টাকা খরচের, গৌতমবাবু ১০.৩২ লক্ষ টাকা খরচের। পূর্ণেন্দুবাবু আবার কোনও হিসেবই দিতে পারেননি। তালিকায় রয়েছেন সদ্য সরকার থেকে বেরিয়ে আসা কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া-ও। অর্ধেক টাকা খরচ করার শংসাপত্র দিতে ব্যর্থ হয়েছেন রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএমের দুই ডাকসাইটে নেতা আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা এবং সুশান্ত ঘোষ। উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে দেরি হওয়ায় ক্ষতি কতটা, তা বোঝাতে পরিকল্পনা দফতরের এক মুখপাত্র বলেন, “সময় বেশি লাগলে খরচ বেড়ে যায়। অথবা অনেক সময় প্রকল্প কাটছাঁট করতে হয়।” ‘ফেল’ করা বিধায়কেরা অবশ্য বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দিতেই নারাজ। যেমন, বালিগঞ্জের বিধায়ক সুব্রতবাবুর কথায়, “বিভিন্ন কাজে কলকাতা পুরসভা, কয়েকটি স্কুল এবং ক্লাবকে টাকা দিয়েছি। পরে নানা সমস্যার কথা শুনি। বিষয়টা দেখতে হবে।” রাজারহাট-গোপালপুরের বিধায়ক পূর্ণেন্দুবাবু আবার প্রাথমিক ভাবে বামফ্রন্ট পরিচালিত রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার দিকে আঙুল তুলেছেন। তাঁর অভিযোগ, “পুরসভার জন্যই ছ’মাস কাজ হয়নি। এখন স্কুলে জল ঠান্ডা করার মেশিন, ভেপার আলো-সহ আরও কয়েকটি কাজ চলছে। আশা করছি, মাসখানেকের মধ্যে ‘ইউসি’ দিতে পারব।” জলপাইগুড়ির ডাবগ্রামের বিধায়ক গৌতম দেব আঙুল তুলেছেন রাজ্যের পূর্ত দফতরের দিকে। তিনি বলেন, “আমার এলাকায় রাস্তা ও সেতু মিলিয়ে পূর্ত দফতরই বেশি কাজ করছে। তারা ‘ইউসি’ দেয়নি। তাই আমিও সেটা জমা দিতে পারছি না।”
সবংয়ের বিধায়ক মানসবাবু বলেন, “আমি বেশির ভাগ টাকা দিয়েছি স্কুলবাড়ি সংস্কারের কাজে। তাতে একটু সময় লেগেছে। কিন্তু পুজোর ঠিক আগেই ৬০% টাকা খরচের ‘ইউসি’ জমা দিয়েছি।” তাঁর কথায়, “এই প্রকল্পের টাকা বিধায়কেরা খরচ করেন না। খরচ করে প্রশাসন।” বাঁকুড়ার রাইপুরের সিপিএম বিধায়ক উপেন কিস্কু পুরো দায় চাপিয়েছেন জেলা প্রশাসনের উপরেই। তাঁর কথায়, “প্রকল্পের বিভিন্ন ধাপে জেলা প্রশাসনের গাফিলতি ও ভুলভ্রান্তির জন্যই সময় বেশি লাগছে।” রাজ্যের উন্নয়ন ও পরিকল্পনামন্ত্রী মণীশ গুপ্ত অবশ্য আশার কথা শুনিয়েছেন। তাঁর দাবি, “প্রথম দিকে কাজ একটু ধীরে হলেও এখন টাকার অঙ্কের তুলনায় বেশি প্রকল্পের প্রস্তাব জমা পড়ছে।”
১০০ জন বিধায়ক গত বছরের অর্ধেক টাকা খরচের ‘ইউসি’ দিতে পারেননি। কিন্তু বাকি ১৯৫ জন বিধায়ক সেই ‘কৃতিত্ব’ অর্জন করে চলতি আর্থিক বছরের প্রথম কিস্তির ৩০ লক্ষ টাকা পেয়েছেন। এই টাকা যোগ করে নতুন সরকারের দেড় বছরে মিলেছে ২২৬ কোটি টাকা, যার মাত্র ২১.৩৪% খরচ হয়েছে এ পর্যন্ত। পরিকল্পনা দফতর সূত্রে খবর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাতে পেয়েছেন ৯০ লক্ষ টাকা। ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি খরচ করেছেন ২৬ লক্ষ টাকা। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় পেয়েছেন ৯০ লক্ষ টাকা। খরচের হিসেব দিয়েছেন ২৫ লক্ষ টাকার। জেলা হিসাবে সব চেয়ে বেশি খরচের খতিয়ান দাখিল করেছে কোচবিহার ও উত্তর দিনাজপুর (৩৩%)। সব চেয়ে কম পশ্চিম মেদিনীপুর (২.৮৬%), যেখানে বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের টাকায় ‘ভাল’ কাজ হচ্ছে বলে দাবি রাজ্যের।
এলাকা উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ রাজ্যের জনপ্রতিনিধিরা কতখানি ‘উৎসাহী’, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় কর্মসূচি রূপায়ণমন্ত্রী সুবোধকান্ত সহায়ের দেওয়া তথ্যেও সেই ছবিটা উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দাবি, এলাকা উন্নয়নে সাংসদদের যে টাকা দেওয়া হয়, তাতে পশ্চিমবঙ্গ গত তিন বছরে ১৩৪ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা খরচ করতে পারেনি। রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার মতে, “বিভিন্ন প্রকল্পে কেন্দ্রের দেওয়া অর্থ খরচের ক্ষেত্রে যেমন গাফিলতি চলতেই থাকে, সাংসদ-বিধায়ক এলাকা উন্নয়নের কাজেও তার ব্যতিক্রম হয় না।” তাঁর মতে, “বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অর্থ সমস্যা নয়। সমস্যা নিয়ম মেনে কাজ করার মানসিকতার। তাই টাকা খরচ হয় না, বা ফিরে যায়। আমরা দিল্লির ঘাড়ে দোষ চাপাই।” |