চঞ্চলা-চরিত
থাটা আগেও বলেছি, তবে ভাল কথা বার বার বলতে দোষ নেই। ছোটবেলায় লক্ষ্মীপুজো বড় ভাল লাগত। কতটা শান্ত, গোলগাল, মাসিমা টাইপ প্রতিমাটির জন্য আর কতটা সন্ধেবেলার প্রসাদ এবং লুচি আলুর দমের জন্য, ভাবিনি। ও সব কূটপ্রশ্ন সেই পৃথিবীতে জন্মায়নি। সৌভাগ্যই বলব, সেই ভাল লাগাটা অনেক দিন সঙ্গে ছিল, মারদাঙ্গার পৌরুষোচিত আকর্ষণ থেকে এ যাত্রা বেঁচে গিয়েছি, যথোচিত বয়সে যথোচিত পুরুষ হয়ে উঠতে হয়নি মা লক্ষ্মীর কৃপাতেই নিশ্চয়ই।
পৌরুষ যা পারেনি, তা পারল নারীবাদ। ফেমিনিজম-এর অপার মায়া, হঠাৎ এক দিন আবিষ্কার করলাম, ওই ঠান্ডা ঠান্ডা ঢলোঢলো মূর্তিটি আসলে পুরুষ-শাসনের এক মোক্ষম চাল, পিতৃতন্ত্র মেয়েদের বশে রাখতে ওই রূপটি বানিয়ে একেবারে ঘরে ঘরে বসিয়ে দিয়েছে, যাতে লড়াই শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়, অন্দরমহলেই। মিথ্যে বলব না, মা জননীকে দেখে তখনও বেশ লাগত, কিন্তু সেই অন্তরের সত্যকে নারীবাদী ‘চোপরাও’ দিয়ে দমিয়ে রাখতে ভুল করিনি। বাড়ি বয়ে আসা লুচি আলুর দমের সদ্ব্যবহারেও অবশ্য ভুল হয়নি প্রসাদে নিয়মো নাস্তি।
পিতৃতন্ত্র সত্য, নারীবাদও। তবে কিনা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খাঁটি সর্ষের তেলেরও ঝাঁঝ কমে যায়, আর এ তো সামান্য ফেমিনিজম। তা, রাগ পড়ে এল, মগজে ঢুকল পাটোয়ারি বুদ্ধি। এমনি তো আর ঢোকেনি, বুদ্ধদেববাবু ঢোকালেন। পশ্চিমবঙ্গের সেই ক্ষণ-জন্মা মুখ্যমন্ত্রী হুঙ্কার দিলেন গ্রাম থেকে শহর, কৃষি থেকে শিল্প, বাঁ দিকে রতন টাটা, ডান দিকে মুকেশ অম্বানী, এই তো উন্নয়ন। শুনতে শুনতে চেতনায় ধাঁধা লেগে গেল, ভাবলাম এই কড়ির ঝাঁপি হাতে চুপটি করে দণ্ডায়মানা নারী তো নিপাট গৃহবধূ, মাটির ভাঁড়ে পয়সা জমিয়ে ছা পোষেন, এঁকে দিয়ে উন্নয়নের হ্রস্ব উ-ও হবে না, আমাদের চাই ধনলক্ষ্মী, মহালক্ষ্মী, তিনিই পারেন এই পিছিয়ে পড়া রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, গরুর গাড়ি থেকে কিংফিশারে চড়াতে।
অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব
ভুল ভাঙতে বেশি দিন লাগেনি। বুদ্ধদেববাবু অচিরেই টের পেলেন, বেশি তাড়াতাড়ি ওপরে উঠতে গিয়েছিলেন, অতএব পার্টি পিছলে একেবারে পপাত চ, হহার চ। আর তাঁকে অমন বেকায়দায় পড়তে দেখে, আবারও, বোধোদয় হল। বুঝলাম, বাঙালির ধাতে ও-সব গুজরাতি বা মরাঠি লক্ষ্মী সয় না, আমাদের ওই গোলগাল নারকেল নাড়ুর মতো মা-ঠাকরুনই ভাল। তাই, একেবারে সেই আদি সাম্যবাদ থেকে শুরু করে সামন্ততন্ত্র, ধনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র হয়ে যেমন সত্যিকারের পাকাপোক্ত, টেকসই সাম্যবাদে পৌঁছনোর কথা, সে রকমই দেখতে দেখতে সেই আনকোরা জীবনপ্রভাতের লক্ষ্মীমন্ত্র থেকে এই অনেক অরণ্য পার হয়ে আসা জীবনসন্ধ্যার লক্ষ্মীতন্ত্রে উপনীত হলাম। এখন বেশ ভারী গলায় বলতে পারি, এই গৃহলক্ষ্মীই আমাদের বাস্তুদেবী।
কিন্তু কেন? কেবল শান্তশিষ্ট বলেই? সেটা একটা কারণ বটে, যত দিন যাচ্ছে, চার পাশে রক্তচক্ষু মুষ্টিবদ্ধ আস্ফালনের ডেসিবেল যত বাড়ছে, চতুর্দিক থেকে সবাই যেমন কথায় কথায় রে রে করে তেড়ে আসছেন, তাতে সত্যিই মনে হচ্ছে, রূপং চাই না, জয়ং চাই না, যশঃ চাই না, উন্নতিও চাই না, নিজের মতো একটু চুপচাপ থাকতে পারলেই বেশ হয়। কিন্তু সেটা গৌণ ব্যাপার।
আসল কথা হল, আমরা আমাদের গৃহলক্ষ্মীর সত্যিকারের মূল্যটা বুঝতে পারিনি। তিনি মোটেই সাতে-পাঁচে-না-থাকা গোলগাল গৃহবধূ নন, বরং হাজার ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে নিজের মতো করে বেঁচে থাকার আশ্চর্য বুদ্ধিটা একমাত্র তাঁরই করায়ত্ত। তিনি জানেন, আমরা লাফঝাঁপ করে বিশেষ কিছু করতে পারব না, আমরা অল্প লইয়া থাকি, সেই অল্পটুকুকেই কী করে নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য ব্যবহার করা যায়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। পশ্চিমের সাহেবরা অনেক সমুদ্রের জল খেয়ে এখন ‘সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট’ বলে দুনিয়া মাথায় করছেন, আমরা দুশো বছরের অভ্যাস মাফিক তাঁদের প্রতিধ্বনি দিচ্ছি, কিন্তু সুস্থায়ী ভাবে বেঁচে থাকার রহস্যটা আমরাই জানতাম। মা লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে সেই হারিয়ে-যাওয়া রহস্য এখনও লুকিয়ে আছে, ভক্তিভরে উদ্ধার করলেই হল।
কী সেই রহস্য? তার উত্তর আছে দেবীর হাসিতে। এ বার লক্ষ্মীপুজোর সময় দু’দণ্ড ভাল করে চেয়ে দেখবেন প্রতিমার মুখপানে, খেয়াল করবেন হাসিটি। ওই হাসি দুর্গার আত্মশক্তি-সচেতন হাসি নয়, সরস্বতীর উচ্চাঙ্গের দুষ্টু হাসিও নয়, ওটি হল অনাবিল সুখের হাসি, যে সুখ নিজের জন্য নয়, কেবল অপরের জন্য। সারা দিনের কাজের শেষে গৃহিণী বাড়ির সবাইকে, তার সঙ্গে দু’চার জন হঠাৎ চলে আসা অতিথিকে খাইয়ে-দাইয়ে যে হাসি অর্জন করেন, ও হল সেই স্বতঃস্ফূর্ত সুখ। এক বার যদি সে সুখের স্বাদ পাওয়া যায়, তবে আর ভাবতে হয় না, তখন টোয়েন্টি ফোর বাই সেভেন মধুমৎ পার্থিবং রজঃ। রবীন্দ্রনাথ এই সুখের কথা জানতেন, কত বার কত সুরে কত কথায় তার খবর দিয়ে গেছেন আমাদের, আমরা পাপীতাপী, বুঝিনি, বুঝতে চাইনি।
কিন্তু এ তো পরার্থপরতার পুরনো কথা হচ্ছে, অপরের সুখে সুখী হওয়ার কথা, এ আর নতুন কী? এর জন্য আলাদা করে লক্ষ্মীর ভজনার কথা উঠছেই বা কেন? কথাটা পুরনো হলেও তাকে নতুন করে জানার দরকার আছে। ভাবার দরকার আছে, লক্ষ্মী কেবল দেওয়ার কথাই বলেন না, দেওয়ার সামর্থ্য অর্জনের কথাও বলেন। তাঁর কাছে এই দুটো কথা আলাদা নয়, বিচ্ছিন্ন নয়, দুটো একে অন্যের সঙ্গে জড়িত, একে অন্যের শর্ত। আমি উপার্জন করব, উন্নতি করব, কারণ আমি সেই উন্নতির উপার্জন অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। আবার, আমি অন্যের সঙ্গে আমার সামর্থ্য ভাগ করে নিতে চাই বলেই আমার সামর্থ্যও বেশি, তাই আমার উন্নতির সম্ভাবনাও বেশি। এই ধর্ম স্বীকার করলে আর উন্নতি ব্যাপারটাই আলাদা আলাদা করে দেখা যায় না, তখন সকলের সমবেত উন্নতিই উন্নতির একমাত্র সংজ্ঞা হতে পারে। একার উন্নতি কুবেরের ধর্ম, সকলের উন্নতি লক্ষ্মীর। কথাটা দারুণ শুনতে লাগল, তাই না? কিন্তু হাততালি পাওয়ার আগে কবুল করি, কৃতিত্বটা আজ্ঞে হ্যাঁ রবীন্দ্রনাথের।
পশ্চিমবঙ্গে আমরা নিজেদের দু’ভাবে নষ্ট করেছি। এক দিকে উন্নতির সামর্থ্য অর্জনের চেষ্টা করিনি, কারণ তাতে পরিশ্রম হয়। আমরা অলস। অন্য দিকে উন্নতিকে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার কথা ভাবিনি, কারণ তাতে পরশ্রী বৃদ্ধি পায়। আমরা পরশ্রীকাতর। স্বভাবতই আমাদের লক্ষ্মী চঞ্চলা।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.