ব্যাগ গুছিয়ে... |
ক্যানভাসে বিলিতি মেজাজ
নিজস্ব স্নিগ্ধতা নিয়ে যেন অন্যান্য পাহাড়ি শহরের থেকে
আলাদা হয়ে যায় ল্যান্সডাউন। লিখছেন সুচন্দ্রা ঘটক |
|
|
পুরনো বাংলোর সাহেবি স্যুটের জানলার বাইরেই সাজানো ক্যান্টনমেন্ট এলাকা। রোদ ঝলমলে আকাশ। সামনের ছোট্ট মাঠে ততক্ষণে জমে উঠেছে রোববারের ফুটবল। কে বলবে গত দু’দিন ভারী বৃষ্টিতে প্রায় ঘরবন্দি ছিল সকলে!
ফুটবল খেলার চত্বরটা পেরিয়ে ডান-বাঁ যে কোনও দিকে দু’পা এগোলেই পুরো বিদেশি ক্ল্যাসিকের মেজাজ। এ যেন একটুকরো বিলিতি ‘কান্ট্রিসাইড’কে ছুঁয়ে দেখার হঠাৎ সুযোগ। ঘুরে ঘুরে নেমে যাওয়া পাহাড়ি রাস্তার ধারে নানা রকমের বাংলো। কোনওটা বা ছোট্ট কটেজ। মিলিটারি স্কুল, ক্যান্টিন পেরিয়ে আরও কিছু দূর এগোলেই গির্জা। পাহাড়ে ঘেরা ফাঁকা রাস্তা ধরে মিনিট কুড়ির পথ হেঁটে ছুটির মন তত ক্ষণে পাক্কা ইউরোপীয়। এমনই কোনও সময়ে ফ্যাশনেব্ল জিন্স-জ্যাকেটে বাইক চালিয়ে পাশ দিয়ে চলে যাবেন কোনও মিলিটারি কর্তার প্রায় মেমসাহেব কন্যা।
সকাল ও সন্ধ্যায় সময় ধরে কিছু ক্ষণ প্রার্থনার জন্য খোলা হয় এই গির্জা। দিনের বাকি সময়টা বন্ধ দরজার সামনের বাগান, চাতালের শান্ত পরিবেশ আর আশপাশের বরফ ঢাকা পাহাড় যেন সর্ব ক্ষণই প্রার্থনায় মগ্ন। সিমলা, মুসৌরি বা দার্জিলিংয়ের মতো বিলিতি মেজাজের পাহাড়ির শহরের থেকে এই জায়গাটাকে কোথাও যেন আলাদা করে রাখে এই অঞ্চলের সেই স্নিগ্ধতাই। ১৭০০ মিটার উচ্চতার এই শহরটা তাই যেন কখনওই দুর্গম ঠেকে না বহু পাহাড় ডিঙিয়ে পৌঁছনো পর্যটকদের কাছেও। |
|
সূর্যাস্তের ঠিক আগে একটু চলে যাওয়া যায় মিলিটারি ক্যান্টিনের সামনে ভুল্লা তালে। সে সময়টা লেকে নৌকো চালিয়ে ঘুরে বেড়ানোর নয়। সামনের সাজানো বাগান, অচেনা ফুল, সিনেমার মতো সাজানো সবুজ ছোট্ট বসার জায়গাগুলোয় কাটিয়ে দেওয়া যায় ল্যান্সডাউনের গোধূলি-বেলা। কুসুমরঙা সূর্যটাও তত ক্ষণে যে হয়ে উঠেছে রীতিমতো ভিন্দেশি! তাই অস্ত যাওয়ার আগে পাহাড়ের গায়ে শুধুই কমলা নয়, নিয়ে আসে নানা রঙের আভা। সন্ধ্যা নামার পরে ক্যান্টিন থেকে স্থানীয় মহিলাদের হাতে বানানো কুকিজ, বিস্কিট, কেক কিনে ফাঁকা রাস্তা ধরে রিসর্টে ফেরার সময়ে একটু গা ছমছম করলেও মনে পড়বেই টম-হ্যারি-পিটারের দলের কান্ট্রিসাইডে ছুটি কাটানোর গল্প বলা সিনেমা। তবু রাস্তায় চোখে পড়বে মিলিটারি কর্তাদের বাংলো, পুরনো অফিস বা দু’শতাব্দী আগে গড়া কোনও ছোট্ট বাড়ি। সান্ধ্য ভ্রমণের শেষে পুরনো বাংলোয় ফিরে মন শুধু রোমাঞ্চে ভরা থাকবে না, সঙ্গে বেশ ইতিহাসমুখীও হয়ে উঠবে হয়তো।
ইতিহাস বলে ল্যান্সডাউন নামক এই গাড়োয়ালি শহরটির আসল নাম ‘কালুনদুন্দা’। কালুন মানে কালো। আর স্থানীয় ভাষায় ‘দুন্দা’ মানে পাহাড়। ১৮৮৭-তে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ল্যান্সডাউনের নামেই এ জায়গার নতুন নাম হয় ‘ল্যান্সডাউন’। ভারতীয় সেনাদের গাড়োয়াল শাখা প্রধানত কাজ করত এই আপাত বিলিতি মেজাজের ছোট্ট এলাকাটা থেকেই। এখনও সেনাদের গাড়োয়াল রাইফেলের সদর দফতরও এখন এখানেই। |
|
ঘুরে দেখা যায় এখানকার প্যারেড গ্রাউন্ডের কাছে ওয়ার মেমোরিয়ালটাও। শান্ত এই জায়গাটা কী ভাবে স্বাধীনতার সময়ের রক্তাক্ত ইতিহাস বুকে ধরে রেখেছে, তা-ই মনে পড়ে যেতে পারে এখানে দাঁড়িয়ে। সাহেবিয়ানার মোহে এত ক্ষণের প্রায় বিলিতি হয়ে যাওয়া মনটা এক ধাক্কায় বদলে যেতে দেরি হবে না।
তবে ব্রিটিশ আমলের গির্জা, বাংলোর বিলিতি মেজাজের পাশাপাশিই দিব্যি বর্তমান এখানকার গাড়োয়ালি অস্তিত্ব। সাজানো-গোছানো এলাকাটা পেরিয়ে বাজারের পথে গেলেই এক্কেবারে অন্য রকম। মিষ্টি থেকে উলের দোকানে রীতিমতো গাড়োয়ালি মেজাজে জমজমাট। কাছেই রয়েছে সন্তোষী মায়ের মন্দির। পুজো দিয়ে আসা যায় সেখানে। হাতে আরও কিছু সময় থাকলে একটু দূরের তারকেশ্বর মহাদেব মন্দিরে ঘুরেও সাহেবিয়ানা থেকে স্বাদ বদল করে নেওয়া যায় খানিকটা। প্রতি বছর শরৎকালের হিন্দু উৎসবও এখানে অনেক পর্যটক টানে।
সেনাদের উপস্থিতির গাম্ভীর্য, সঙ্গে পাহাড়ি আতিথেয়তা মিলিয়ে এ অঞ্চল একেবারেই নিজের মতো। রোজনামচার হুড়োহুড়ির চেয়ে বহু দূরে এখানকার স্নিগ্ধতা আর দূষণমুক্ত বাতাস কয়েক দিনেই তাই সুস্থ করে তুলতে পারে শরীর-মন। পাইন-ওক গাছে ঘেরা রাস্তায় প্রাতর্ভ্রমণ আর লেকে নৌকাবিহার করেই কাটিয়ে দেওয়া যায় একটা সপ্তাহান্ত।
|
কী ভাবে যাবেন |
সবচেয়ে কাছের বিমানবন্দর দেরাদুনের জলিগ্রান্ট। সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় ল্যান্সডাউন।
হরিদ্বার বা কোটদ্বার থেকে বাস অথবা ভাড়া গাড়িতেও পৌঁছনো যায় ল্যান্সডাউন। |
কোথায় থাকবেন |
সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন রিসর্ট ও হোটেল রয়েছে এই অঞ্চলে। |
কোন সময়ে যাবেন |
এখানকার আবহাওয়া বছরভর বেশ ভালই থাকে। ডিসেম্বর থেকে ঠান্ডা বাড়ে।
বরফ পেতে হলে জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে যাওয়াই ভাল। |
|
|
|