ছুটি কাহাকে বলে? আপনার অভিরুচি মাফিক অলস কালযাপনকেই আমরা ছুটি বলিয়া থাকি। এই কালযাপনের সময়টি কিন্তু অনন্ত নহে, সুনির্দিষ্ট। ছুটি দীর্ঘ হইতে পারে, স্বল্প হইতে পারে। ছুটির পর আমাদের কাজেই ফিরিতে হয়। ছুটি যেন কাজে যাইবার উপক্রমের ও আয়োজনের সময়। ছুটি না থাকিলে কাজ হইবার নহে। পরস্পর যেন পরস্পরকে ঘিরিয়া থাকে। কথাটি বুঝি আধুনিক বাঙালিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ সবার চাহিতে ভাল উপলব্ধি করিয়াছিলেন। উনিশ শতকে বাঙালি যে সময়ে ইংরেজদের উপনিবেশের মধ্য দিয়া আধুনিক অর্থনীতি ও সমাজনীতির অংশীদার হইতেছিল, সেই সময়ে আক্ষরিক অর্থেই ছুটির সময়কে ঢালিয়া সাজিতে হইয়াছিল। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সহিত বঙ্গসংস্কৃতির সংযোগে ছুটির কারণ ও বিন্যাস পরিবর্তিত হইল। কৃষিনির্ভরতা আর ঔপনিবেশিক শাসনে গড়ে ওঠা নবনির্মিত জনগোষ্ঠীর একক বৈশিষ্ট্য নহে।
বেশে বাঙালি কাজের মেজাজে সাহেব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকাকালীন ছুটির পুনর্বিন্যাস ঘটাইলেন। কৃষিভিত্তিক বঙ্গদেশে ইহার আগে চাষের সুবিধা অনুযায়ী নানা সময়ে শিক্ষালয় বন্ধ থাকিত। বিদ্যাসাগর নানা সময়ের পরিবর্তে ছুটির সুনিয়মিত পঞ্জি নির্মাণ করিলেন। অর্থাৎ প্রাচীন ছুটি হইতে আধুনিক ছুটিতে আসিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই আধুনিক উনিশ শতকের বাঙালি। বুঝিয়াছিলেন, ছুটির নবপঞ্জি নির্মাণ করিলেই হইবে না, ছুটির মর্জিটি যথাযথ বুঝিয়া লওয়া দরকার। তাহা না হইলে কাজ ও ছুটি দুই মাটি হইবে। প্রিয়পাত্রী রাণুকে লেখা একটি চিঠিতে এক বার রবীন্দ্রনাথ তাঁহার কাজের তালিকা প্রদান করিয়াছিলেন। সেই কাজের তালিকায় বেশ কয়েক বার নিভৃতে চুপ করিয়া বসিয়া থাকার কথা ছিল। বসিয়া থাকা কেন কাজ হইবে? কাজ নহে, তাহা ছুটি। কাজের উপক্রম। কাজের প্রস্তুতি। কাজ ও ছুটির এই অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক বুঝিতেন বলিয়াই রবীন্দ্রনাথ অজস্র কাজ করিতে পারিয়াছিলেন। তাঁহার সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানের মর্জিটিই ছিল এই প্রকার কাজেতে ছুটিতে মিলিয়া মিশিয়া একাকার। আম বাঙালি অবশ্য এ সব ভাবিয়াও দেখে না, পালন করা তো দূর অস্ত্। ছুটির হ্যাংওভার তাহাদের কিছুতেই যেন কাটিতে চাহে না। কাজের মণ্ডপে ছুটির উদ্গার তুলিতে তুলিতে তাহাদের প্রবেশ। ছুটি ফেলিয়া যে এ বার কাজে নামিতে হইবে সে বোধ নাই। আসলে উদ্দেশ্যহীন গয়ংগচ্ছ সময়যাপন বাঙালির মজ্জাগত। ফেলিয়া আসা ছুটির দিনগুলিকে তাই সে চূড়ান্ত ভাবে উপভোগ করে নাই, ছুটি যে কাজে ফিরিবার ধাপ তাহা মানে নাই। দুর্গাপূজার ছুটি বাঙালিকে চার দিন দেওয়াই হোক বা দশ দিন, ফল একই। রাবীন্দ্রিক বা বিলিতি, কোনও ছুটির মডেলই বাঙালির নিকট মাননীয় নহে। ছুটি ও কাজের যে কার্যকর মডেলটি পাশ্চাত্যে কার্যকরী এই বঙ্গে তাহা চালু হওয়া দুষ্কর। উইক-এন্ডের মর্ম কি বঙ্গজরা বোঝে? বাঙালি অকাজের চোরাবালিতে ডুবিতেছে। ছুটি ও কাজের পারস্পরিক সম্পর্ক না বুঝিলে আরও ডুবিবে। |