নয়াদিল্লির বাতাসে শীতের ছোঁওয়া লাগিয়াছে। দুর্নীতির ঋতু অবশ্য অপরিবর্তিত। কংগ্রেস এবং তাহার সহযোগীদের গাঁ উজাড় হওয়ার পর এই বার বিজেপি-র পালা। দলের সভাপতি নিতিন গডকড়ীর বিরুদ্ধে প্রবল দুর্নীতির অভিযোগ উঠিয়াছে। প্রশ্ন হইল, দুর্নীতির অভিযোগ উঠিবার পর গডকড়ী, সলমন খুরশিদ বা অন্য যে কোনও রাজনীতিকের কী করণীয়? অভিযোগ উঠা এবং তাহা প্রমাণিত হওয়া যে দুইটি ভিন্ন ঘটনা, সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নাই। বস্তুত, যত ক্ষণ না অভিযোগ প্রমাণিত হইতেছে, অভিযুক্তকে নির্দোষ ভাবাই বিধেয়। ইহা সমাজের নৈতিকতার প্রশ্ন। অন্য দিকে, অভিযুক্ত রাজনীতিকদের নিকটও নৈতিকতার একটি দাবি আছে। যে মুহূর্তে কোনও দুর্নীতির অভিযোগে তাঁহাদের নাম জড়াইয়া পড়ে, তাঁহাদের কর্তব্য, তৎক্ষণাৎ নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক পদ হইতে সরিয়া দাঁড়ানো। ভারতে এমন দৃষ্টান্ত আছে। বস্তুত, গডকড়ীর দলেই আছে। ১৯৯৬ সালে সি বি আই হাওয়ালা মামলায় লালকৃষ্ণ আডবাণীকে অভিযুক্ত করে। আডবাণী কালক্ষেপ না করিয়া সাংসদ পদে ইস্তফা দিয়াছিলেন। নির্দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি কোনও সাংবিধানিক পদ গ্রহণ করেন নাই। এই উদাহরণটি অনুসরণ করিতে রাজনীতিকদের আপত্তি কোথায়? তাঁহাদের কি নিজেদের উপর ভরসা নাই? তাঁহারা কি নিজেদের অপরাধহীনতায় নিজেরাই বিশ্বাস করেন না?
এহ বাহ্য। রাজনীতিকরা বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করিবেন বটে, কিন্তু সেই বিচার কবে শেষ হইবে, ভারতে তাহা কে বলিতে পারে? ভারতে বিচারবিভাগের দীর্ঘসূত্রতা বিষয়ে বহু বার বহু আলোচনা হইয়াছে। দুর্নীতির অভিযোগ বিচারের ক্ষেত্রে, বোধ হয়, এই রোগ আরও প্রবল। একটি কথা হাওয়ায় ভাসিতেছে রজত গুপ্ত যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে ভারতে অপরাধটি করিতেন, তাঁহাকে হয়তো কখনও কোনও শাস্তি পাইতে হইত না। রজত গত দীপাবলিতে মার্কিন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এই বিজয়ায় তাঁহার শাস্তি ঘোষিত হইয়াছে। যে কোনও আধুনিক, সভ্য দেশে এই গতিতেই বিচার হইয়া থাকে। ভারত ব্যতিক্রম। রজত যে অপরাধে অপরাধী, ভারতে সেই অপরাধ প্রকাশ্যে আসিবার চৌদ্দো বৎসর পরেও অপরাধীর শাস্তি হয় নাই। ফলে রাজনীতিকরা জানেন, দুর্নীতির যে অভিযোগই তাঁহাদের বিরুদ্ধে উঠুক না কেন, শেষ পর্যন্ত তাঁহারা যেমন আছেন, তেমনটিই থাকিবেন। বড় জোর কিছু দিন লোকলজ্জা সহিতে হইবে। সে ভয়ে সচারচর বীর হৃদয় কম্পিত হয় না। অপরাধ করিলেও শাস্তি না হইবার এই অলিখিত নিশ্চয়তাই ভারতে দুর্নীতিকে জাতীয় ক্রীড়ায় পরিণত করিয়াছে। সুরেশ কলমডী হইতে নিতিন গডকড়ী, সকল প্রান্তেই দুর্নীতির সমান বেসাতি। এবং এই কারণেই অণ্ণা হজারের অগণতান্ত্রিক পথও ভারতে প্রবল জনপ্রিয় হয়। এই কারণেই অরবিন্দ কেজরিওয়াল বিকাল পাঁচটা বাজিলেই টেলিভিশনের ক্যামেরার সম্মুখে অভিযোগের ডালা লইয়া বসেন। ভারতবাসী অভিজ্ঞতায় বুঝিয়াছেন, দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় অসৎ রাজনীতিকদের শাস্তিবিধানের আশা নাই। বিনা সাজায় তাঁহারা পার পাইবেন, এই কথাটিও আম জনতা মানিতে পারেন না। ফলে তাঁহাদের সম্মুখে একটিই পথ অবশিষ্ট থাকে ‘জন আদালত’। জনতার দরবারে দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিকদের এক প্রকার ‘বিচার’ হয়। সেই বিচারের হোতা অণ্ণা হজারে, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, কিরণ বেদিরা। পুলিশের সহিত অপরাধীদের যোগসাজশ দেখিতে দেখিতে ক্লান্ত জনতা গণপিটুনির পথ বাছিয়া লইলে সভ্য সমাজের যে ক্ষতি, গণ আদালতে ‘বিচার’-এ ক্ষতি তাহার কণাপরিমাণও কম নহে। এই অভ্যাস গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির ভিতে আঘাত করে, রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের বিশ্বাস নষ্ট করে। তাহার দায় সাধারণের উপর চাপাইয়া দিলে বালিতে মুখ লুকানো হয়। দায় প্রশাসনের। যে রাষ্ট্র দুর্নীতিপরায়ণ নেতাদের প্রকৃষ্ট বিচারের ব্যবস্থা করিতে পারে না, নাগরিক তাহার উপর ভরসা করিবে কেন? নিতিন গডকড়ী সত্যই অবিলন্বে পদত্যাগ করিলে গণতন্ত্রের মঙ্গল। দুর্নীতির বিচার তরান্বিত হইলেও গণতন্ত্রই সবল হইবে। |