|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা... |
|
বিশ্বাস, সততা আর জেদের চট্টগ্রাম |
শুধু সেই জন্যই দেখা উচিত। লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায় |
বছর পঁয়তাল্লিশের এক ভদ্রলোক। বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র। নাসা-র প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী। সব ছেড়েছুড়ে হঠাৎ ছবি বানাতে লেগে পড়লেন। সেটাও আবার নিজের টাকায়!
কেমন ছবি? সায়েন্স ফিকশন না। থ্রিলার না। প্রযুক্তির ফুলঝুরি ছোটানো, চোখ-ধাঁধানো সাইবার-ফিল্ম না। ডায়াস্পোরা-র ফ্যামিলি ড্রামা না।
ছোটবেলার ইতিহাস বইয়ে পড়া চট্টগ্রাম বিদ্রোহের কাহিনি।
কাহিনি বলাও ভুল হল। ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ে কাহিনি তো থাকে না। থাকে সাল-তারিখ-নামের লম্বা লাইন। সবাই জানে, ইতিহাস ব্যাপারটা বিরাট বোধবুদ্ধি খাটানোর ব্যাপার নয়। মুখস্থ করে উগরে দিয়ে আসার ব্যাপার। ইতিহাসের সঙ্গে নিজের জীবনের খুব একটা সম্পর্ক আছে বলে সচরাচর ভাবে না কেউ। হাজার হোক, নেতাজি-ক্ষুদিরাম-সূর্য সেনের নামগুলো মেট্রো স্টেশন ছাড়া আর কোনও কাজে লাগে কি? বুকে হাত দিয়ে বলুন তো!
অথচ কী আশ্চর্য দেখুন, বেদব্রত পাইন কিনা মধ্য চল্লিশে পৌঁছে চাকরি-বাকরি ছেড়ে জীবনে প্রথম বার সিনেমা করতে এলেন চট্টগ্রাম বিদ্রোহের গল্প বলবেন বলে!
পশ্চিমের দেশগুলো আজ অবধি বিশ্বযুদ্ধ বা হলোকাস্টের গল্প সেলুলয়েডে বলতে ক্লান্ত বোধ করে না। তার পাশে আমরা, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র, নিজের স্বাধীনতা যুদ্ধের ক’টা আখ্যান ঠিকঠাক ভাবে পর্দায় আনতে পেরেছি? আঙুলের কড় গুনে দেখুন, বলিউড স্বাধীনতা-আন্দোলন নিয়ে ক’টা ছবি করেছে আর স্বাধীন ভারতের মাফিয়া ডনদের নিয়ে ক’টা ছবি হয়েছে? শুধু এই জন্যই তো ‘চিটাগং’ বানানোর সাহসটাকে সম্মান জানানো উচিত!
আশুতোষ গোয়ারিকরের ছবির কথা মনে করিয়ে দেবেন তো? বলবেন তো যে, চট্টগ্রাম কাহিনি নিয়ে তিনি তো ক’দিন আগেই ‘খেলে হম জি জানসে’ বলে একটা ছবি করেছেন?
দু’টো কথা বলি এ প্রসঙ্গে। এক, আশুতোষ ছবিটা করার অনেক অনেক আগে থেকেই কিন্তু বেদব্রত ‘চিটাগং’ ছবির প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলেন! চিত্রনাট্যের ১৮তম খসড়া শেষ হচ্ছে, এমন সময় উনি জানতে পারলেন, আশুতোষ এই বিষয় নিয়েই ছবি করতে যাচ্ছেন! |
|
চিটাগং মনোজ বাজপেয়ী, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি, দিলজাদ, ভেগা তমোটিয়া |
কোথায় ‘লগান’, ‘জোধা-আকবরে’র মতো পিরিয়ড পিস বানাতে সিদ্ধহস্ত আশুতোষ! কোথায় অভিষেক বচ্চন-দীপিকা পাড়ুকোনের স্টার পাওয়ার! আর কোথায় তখন বেদব্রত! নাসা-র বিজ্ঞানী হতে পারেন! কিন্তু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির তো কেউ না! কষ্ট হল না? মুষড়ে পড়লেন না? “একটু হয়েছিল”, মুচকি হাসেন বেদব্রত। “তার পর রোখ চেপে গেল, জানো?”
ভাগ্যিস রোখটা চেপেছিল! দু’নম্বর কথাটা বলি এ বার। ‘খেলে হম জি জানসে’ দেখেছিলেন কি? যদি দেখে থাকেন, তা হলে তার সঙ্গে তফাতটা দেখার জন্যই ‘চিটাগং’ দেখুন! দেখা উচিত, দেখা দরকার। আশুতোষের ছবি যদি হয় বলিউডি অ্যাকশন-থ্রিলারের ফর্ম্যাটে দেশভক্তির ককটেল, বেদব্রতর ছবি আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসের একটা পর্বকে রিক্রিয়েট করার চেষ্টা।
আধুনিকতাটা কোথায়? যাঁরা মনে করেন, চোখের পাতা ফেলতে না দেওয়া জেট-গতির কাট-টু-কাট ন্যারেটিভই আধুনিকতার অভিজ্ঞান, তাঁরা হতাশ হবেন (বরং অনেক দিন পর ডিজল্ভ দেখতে পেয়ে নস্টালজিক বোধ করতে পারেন)। যাঁরা ‘রং দে বসন্তী’র মতো কোনও ট্রিটমেন্ট আশা করছেন, তাঁরাও ঠিক ভাবছেন না। ‘চিটাগং’ আদ্যন্তই একটি পিরিয়ড পিস। যা স্বাধীনতা-যোদ্ধাদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রেখেও শুধু একটা বীরগাথা নয়। ‘ভুলি নাই’ বা ‘’৪২’ গোত্রীয় ছবির সঙ্গে এখানেই তার তফাত। মনোজকুমারীয় দেশভক্তির সঙ্গে এখানেই তার আলোকবর্ষের দূরত্ব। ‘মেকিং অব মহাত্মা’ বা ‘বোস দ্য ফরগটেন হিরো’র থেকেও তার মেজাজ একদম আলাদা। চিটাগং-এর মূল চরিত্র, ১৪ বছরের ঝুংকু কোনও অতিমানব না। তার ভয় আছে, দ্বিধা আছে, দ্বন্দ্ব আছে। সে মাস্টারদার কাছে এ কথাও বলে ফেলতে পারে যে, রাতের অন্ধকারে জালালাবাদ পাহাড় থেকে নেমে বাড়ি চলে যাওয়ার ইচ্ছা এক বার তার মনে জেগেছিল। তীব্র ভাবেই জেগেছিল। মার খেয়ে রক্তাক্ত হতে হতেও ঝুংকু মাস্টারদা’র হদিস পুলিশকে দেয় না ঠিকই। পাশাপাশি এ কথাও সমান ভাবে সত্য যে, জেলের দরজায় বাবাকে দেখে সে ডুকরে ওঠে, আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো!
আর মাস্টারদা (মনোজ বাজপেয়ী)! দ্বিধা কি তাঁরও নেই?
তাঁরও তো মনে হত, ইতিহাস তাঁকে কী ভাবে মনে রাখবে? এতগুলো বাচ্চা ছেলেকে যুদ্ধ করতে নামানো কি উচিত কাজ হয়েছে? এখানেই ‘চিটাগং’ সবচেয়ে আধুনিক! ‘সব ঝুট হ্যায়’ বলে ইতিহাসকে নস্যাৎ করার মতো ওপরচালাকি নয়! আবার প্রশ্নহীন ভক্তি-গদগদ অমর চিত্রকথাও নয়! একটা প্রজন্মের বিশ্বাস, সততা আর জেদকে একই রকম বিশ্বাস, সততা আর জেদ নিয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা।
বিশ্বাস, সততা আর জেদ। ঠিক এই তিনটে জিনিসই ছবিটার প্রতিটা ফ্রেম থেকে বিচ্ছুরিত হয়। ‘চিটাগং’ দেখতে বসে তাই ‘কী হতে পারত’, ‘কী হয়নি’ জাতীয় কাটাছেঁড়া করতে ইচ্ছে করে না। চিটাগং মহৎ ক্লাসিক না-ই হতে পারে, কিন্তু চিটাগং তার দরদটুকু নিয়ে আপনাকে স্পর্শ করবে। ঝুংকুর ভূমিকায় দিলজাদ আর প্রীতিলতার ভূমিকায় ভেগা তমোটিয়া দুই নবাগতের নিষ্পাপ অভিনয় নাড়া দিয়ে যায়। মনোজ বাজপেয়ী, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকিদের এই অচেনা চেহারায় দেখে ভাল লাগবে। উত্তরবঙ্গের নিসর্গ, এরিক জিমারম্যানের ক্যামেরা আর শঙ্কর-এহসান-লয়ের সঙ্গীত অসামান্য। তবে একটা কথা, ১৯২৯ সালে কিন্তু ব্যোমকেশের গল্প লেখা শুরু হয়নি। এটা একটু খেয়াল রাখলে ভাল হত!
২০০৫ সাল থেকে ছবিটার ভাবনা শুরু করেছিলেন। ছবিটা তৈরি হয়ে মুক্তি পেতে পাক্কা সাত বছর লাগল। “কোনও ফিল্ম স্কুলের ডিগ্রি ছিল না। কাউকে কোনও দিন অ্যাসিস্ট করিনি। কিচ্ছু জানতাম না। শুধু জানতাম, ছবিটা করতে চাই।” বিশ্বাস, সততা আর জেদ থাকলে যে সেটা সম্ভব হয়, সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন বেদব্রত। শুধু সেই জন্যও তো চিটাগং দেখা উচিত, তাই না? |
|
|
|
|
|