চেনা ছবিটা বদলে দেওয়ার দাবি ছিল। সেই মতো তর্জন-গর্জনও কম ছিল না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী, তথা রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশকে কার্যত উপেক্ষা করেই পুজোর হাসপাতালে সেই ‘ছুটি’-র ধারাই বজায় থাকল। পুজোর চার দিন সরকারি হাসপাতালে যত চিকিৎসকের উপস্থিত থাকার কথা ছিল, তার ৭০% ছিলেন গরহাজির। ইনডোরের রোগীরা ডাক্তারের দেখা পেয়েছেন কালেভদ্রে। পঙ্গু ছিল জরুরি বিভাগও।
পুজোর চার দিন সরকারি হাসপাতালে অঘোষিত ‘ছুটি’র ট্র্যাডিশন চলত বাম আমলে। এ বার তা বদলাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। হাসপাতালে কোন ডাক্তারের কবে, কখন ডিউটি-- তা স্থির করতে সবক’টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। বিভাগীয় প্রধানদের তৈরি করা সেই তালিকা পৌঁছে গিয়েছিল স্বাস্থ্য ভবনেও। স্বাস্থ্যকর্তারা দাবি করেছিলেন,পুজোয় সরকারি হাসপাতালে হয়রানির চেনা ছবিটা এ বার বদলাবে। বাস্তবে পরিস্থিতি সেই একই থাকল। অভিযোগ, পুজোর দিনগুলিতে পরিষেবা তো মেলেইনি, এমনকী পরিষেবা না মেলায় অভিযোগ জানানোরও সুযোগ ছিল না। চেষ্টা করেও হাসপাতালগুলিতে প্রশাসনিক কর্তাদের দেখা মেলেনি।
ঘোষণা ছিল, রোগীদের দুর্ভোগ কমাতে এ বারে অষ্টমীর পরিবর্তে দশমীর দিন ‘আউটডোর’ বন্ধ থাকবে। স্বাস্থ্য দফতরে বক্তব্য ছিল, এ বার সপ্তমী রবিবার হওয়ায় এমনিতেই আউটডোর বন্ধ। সোমবার অষ্টমীর দিনও আউটডোর বন্ধ থাকলে পর পর দু’দিন ছুটি হয়ে যাবে। এতে মানুষের ভোগান্তি বাড়বে। তাই অষ্টমীর পরিবর্তে দশমীর দিন আউটডোর বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করা হয়। সরকারের এই সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়ে ফিরেছে। দিন বদলের সুযোগ নিয়ে অষ্টমীর দিন চিকিৎসক-নার্সরা কাজে যোগ দেননি। ফলে চার দিনের পুজোয় এক মাত্র নবমী বাদ দিয়ে বাকি তিন দিনই আউটডোর কার্যত বন্ধ ছিল। আউটডোরের এই সঙ্গীন অবস্থার খবর পৌঁছেছে স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে। কারা সরকারি নির্দেশ অগ্রাহ্য করেছেন, সেই তালিকাও তৈরি হচ্ছে বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর। বেসরকারি হাসপাতালের অবস্থা অবশ্য আরও সঙ্গীন ছিল। ফলে রোগী এবং তাঁদের পরিবারের দুর্ভোগের মাত্রা বেড়েছে কয়েক গুণ।
কেমন দুর্ভোগ? অষ্টমীর দুপুরে তিন তলার ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হন পার্ক সার্কাসের বাসিন্দা শেখ ওসরাফ। রক্তাক্ত ওসরাফকে নিয়ে তাঁর পরিবারের লোকেরা যখন ন্যাশনাল মেডিক্যালে পৌঁছন, ততক্ষণে পার্ক সার্কাসে পুজোর ভিড় জমে উঠেছে। অভিযোগ, ইমার্জেন্সি থেকে তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়, মাথায় আঘাত, তাই নিউরো সার্জারি বিভাগে ভর্তি করা প্রয়োজন। কিন্তু হাসপাতালে ওই বিভাগে তখন কেউ ছিলেন না। তাই ভর্তি নেওয়া হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হ। ওসরাফের ছেলে আমির বলেন, “শুধু একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে আব্বাকে ওখান থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। উপায় না দেখে আমরা তখন কাছেই একটা নার্সিংহোমে ভর্তি করি। সেখানে ও কোন ডাক্তার ছিলেন না। বিনা চিকিৎসায় ৪৮ ঘন্টা সেখানে পড়ে ছিলেন বাবা। এখনও তাঁর জ্ঞান ফেরেনি।” নবমীতে এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে অতসী হালদার নামে এক বৃদ্ধাকে বিনা চিকিৎসায় ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পেটে ব্যথা ও ক্রমাগত বমি নিয়ে পরিবারের লোকেরা তাঁকে এসএসকেএমে এনেছিলেন। অভিযোগ, ইমার্জেন্সি থেকে বলা হয়, ‘ডাক্তার নেই, অন্যত্র নিয়ে যান।’ শেখ ওসরাফ এবং অতসীদেবীর পরিবারের লোকেরা বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
স্বাস্থ্য দফতরের খবর, অষ্টমীর ছুটি বাতিল করার সিদ্ধান্তে বিরক্ত হয়েছেন চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ। তার জেরেই অনেকে গোটা পুজোটাই ‘মেডিক্যাল লিভ’ নিয়েছেন। কিন্তু কেন এই ক্ষোভ? চিকিৎসক সংগঠন হেলথ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন-এর তরফে চিকিৎসক রেজাউল করিম বলেন, “এই সিদ্ধান্তটা একেবারে শেষ মুহূর্তে জানানোয় সকলেই বিপাকে পড়েন। শুক্রবার বিকেলে সার্কুলার দিয়ে জানানো হয়, সোমবার বন্ধ থাকবে। পুজোতে প্রত্যেকের নিজস্ব পরিকল্পনা থাকে। তাকে বিন্দুমাত্র মর্যাদা দেওয়া হয়নি।” স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ন’টি মেডিক্যাল কলেজে প্রায় ৭০ জন বিভাগীয় প্রধান পুজোর চার দিন তো বটেই, তার পরের সপ্তাহটাও ছুটিতে রয়েছেন। পুজোর পুরো সপ্তাহটা ছুটির আবেদন করেন প্রায় দু’হাজার চিকিৎসক এবং সাত হাজার নার্স।
রাজ্যের স্বাস্থ্য-প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেছেন, “নজরদারি চলেছে। হাজির থাকার কথা থাকলেও ওই দিনগুলিতে ছিলেন না--এমন প্রমাণ পাওয়া গেলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তাঁর কথায়, “অন্য বিভাগের ছুটির সঙ্গে স্বাস্থ্যের ছুটি গুলিয়ে ফেললে চলবে না।” সিপিএম প্রভাবিত চিকিৎসক সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টরস-এর সদস্যদের মতে, “টানা ১০ দিন সরকারি ছুটির হাওয়া স্বাস্থ্য পরিষেবাতেও লেগেছে। এক দিকে বলা হচ্ছে পুজোর সময়ে মেডিক্যাল কলেজ, জেলা ও মহকুমা হাসপাতালের আউটডোর খোলা থাকবে। কিন্তু সেটা চালাবেন কারা, সেই প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে নেই।” |