বাড়ির কাছেই পরপর গুলি করে কয়লা মাফিয়া শেখ সেলিমকে খুন করল দুষ্কৃতীরা। বৃহস্পতিবার বিকেলে ঘটনাটি ঘটে ফরিদপুর (লাউদোহা) থানার মাধাইগঞ্জে। দুর্গাপুর ইস্পাত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা সেলিমকে (৬২) মৃত ঘোষণা করেন।
গত প্রায় তিন দশক ধরে অবৈধ কয়লা কারবারে যুক্ত থাকা ছাড়াও খুন, জখম, বোমাবাজির নানা অভিযোগ রয়েছে শেখ সেলিমের বিরুদ্ধে। দীর্ঘদিন জেলও খেটেছে সে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ইদানীং নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল সেলিম। বৃহস্পতিবার বিকেলে মাধাইগঞ্জে বাড়ির সামনে নিজের পেট্রোল পাম্পে গাড়ি রেখে বাড়ির দিকে যাচ্ছিল সেলিম। সেই সময়ে তিন দুষ্কৃতী মোটরবাইকে চড়ে এসে খুব কাছ থেকে তাকে পরপর গুলি করে পালিয়ে যায়। কয়েকটি গুলি লাগে সেলিমের গায়ে। রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়ে সে। ওই দুষ্কৃতীরা চম্পট দেয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় পুলিশ। সেলিমকে হাসপাতালে পাঠানো হয়।
পুলিশ জানায়, ঘটনাস্থল থেকে বেশ কয়েকটি গুলির খোল পাওয়া গিয়েছে। ঘটনাস্থলের ছবি তোলা হয়েছে। অন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। আসানসোল-দুর্গাপুরের এডিসিপি (পূর্ব) সুনীল যাদব বলেন, “মৃতের শরীরে কতগুলি গুলি লেগেছে, তা ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে পরিষ্কার হবে। তদন্ত চলছে।” |
এ দিন সেলিমের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে হাসপাতালে যান তৃণমূলের ব্লক সভাপতি সুজিত মুখোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, “কয়লার কারবার ছেড়ে সেলিম স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় ছিল। কিন্তু পায়ের তলায় মাটি সরে যাওয়ায় সিপিএম তাঁকে খুন করে পঞ্চায়েত ভোটের আগে এলাকায় সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরির চক্রান্ত করেছে।” সিপিএম অবশ্য অভিযোগ মানেনি। দলের জেলা সম্পাদক অমল হালদারের পাল্টা বক্তব্য, “কয়লা পাচারকারীদের দ্বন্দ্বের জেরে এমন ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। কয়লা পাচারের রাশ হাতে নিতে কেউ এমন ঘটিয়ে থাকতে পারে। শুনেছি, তৃণমূলের এক গোষ্ঠীর সঙ্গেও ওই কয়লা মাফিয়ার ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। তাই এর পিছনে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও থাকতে পারে।”
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, সেলিমের আদি বাড়ি ফরিদপুর (লাউদোহা) থানার কৈলাসপুরে। ইসিএলের অনেক কর্মী সংস্থা থেকে পাওয়া ‘ডোমেস্টিক কোল’ গরুর গাড়িতে করে বাড়ি নিয়ে যেতেন। পরিমাণে প্রচুর হওয়ায় অনেকে তা বিক্রিও করে দিতেন। অল্প বয়সে সেই কয়লা অল্প দামে কিনে তার পরে তা অন্যত্র বিক্রি করতেন সেলিম। সে ভাবেই কারবারে তার হাতেখড়ি। পরে পাণ্ডবেশ্বরের মাধাইবনি কোলিয়ারি থেকে মাঝে-মধ্যে গরুর গাড়িতে করে কয়লা বের করে আনা শুরু করে সে।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ১৯৮৩ সালে ঝাঁঝড়া কোলিয়ারি চালু হওয়ার পরে কয়লার চোরা কারবার করে রাতারাতি ফুলে ফেঁপে ওঠে সেলিম। সেই সময়ে দিনে ৭-৮ হাজার টন কয়লা তোলা হত। তা থেকে কয়েকশো টন সরিয়ে ফেলত সেলিম। কৈলাসপুর থেকে সে উঠে আসে মাধাইগঞ্জে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অবৈধ কয়লা কারবারে হাত পাকানোর পাশাপাশি তৎকালীন শাসক দলের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছিল সেলিম। সিপিএমের নানা প্রকাশ্য সভা-সমিতিতেও তাকে দেখা যেত বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি। সিপিএম অবশ্য এই অভিযোগ মানেনি।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বছর আটেক আগে থেকে বেআইনি কয়লা কারবারে সেলিমের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে তারই এক সময়ের ‘ডান হাত’ শেখ আমিন। এলাকা দখল নিয়ে তাদের মধ্যে মাঝে-মধ্যে বোমা-গুলির লড়াই বাধত। প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দু’পক্ষের লোকজনকে ঘোরাঘুরি করতেও দেখা যেত বলে জানান এলাকার বাসিন্দারা। সন্ত্রাসের এমন বাতাবরণে রুখে দাঁড়ান সেই সময়ের শাসক দলের কয়েক জন। কয়লা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলনে নামেন সিপিএমের লাউদোহা লোকাল কমিটির সদস্য শেখ ফারুখ হোসেনের মতো নেতারা।
সেলিম অবশ্য তার আগেই মাধাইগঞ্জে নিজের বিশাল বাড়ি, কাঠগোলা, পেট্রোল পাম্প তৈরি করে ফেলেছে। ২০০৮-এর ১০ জুন সকালে কৈলাসপুর থেকে মাধাইগঞ্জ যাওয়ার সুনসান রাস্তায় সেলিমের গাড়ি লক্ষ করে গুলি ও বোমা ছোড়ে আমিনের দল। তবে সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যায় সেলিম। সিপিএমের তরফে জানানো হয়, কয়লা কারবারিদের অন্তর্দ্বন্দ্বেই এমন ঘটনা। সেই বছরের ২৩ জুলাই দুর্গাপুর থেকে ফেরার পথে কেন্দোলা মোড়ে খুন হন শেখ ফারুখ হোসেন ও তাঁর সঙ্গী সুধীর বাউড়ি। এই ঘটনায় তার দিকে অভিযোগ ওঠার পরেই আত্মগোপন করে সেলিম। প্রায় পাঁচ মাস পরে বর্ধমান থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদে পালিয়ে বেড়ানোর পরে বোকারোয় গিয়েছিল সেলিম। চিকিৎসার প্রয়োজনে সেখান থেকে বর্ধমানে এসেই ধরা পড়ে যায় সে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন জেল খেটে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরে নিজেকে গুটিয়ে নেয় সেলিম। ২০১১-এর ফেব্রুয়ারিতে দুই তৃণমূল কর্মী খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত কয়লা মাফিয়া শেখ আমিনকে মাধাইগঞ্জ থেকে ধরে পুলিশ। সে এখনও জেলে। এর ফলে এলাকায় শান্তি ফিরেছিল বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পর থেকে অবশ্য সেলিম তৃণমূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছিলেন বলে স্থানীয় সূত্রে খবর। স্থানীয় একটি স্কুলের পরিচালন সমিতির ভোটের সময়ে তৃণমূলের কর্মীদের সঙ্গে প্রকাশ্যে তাকে দেখাও গিয়েছিল।
তবে সেলিমকে খুনের ঘটনায় কারা জড়িত, তা জানাতে পারেনি পুলিশ। এডিসিপি (পূর্ব) সুনীল যাদব বলেন, “ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দু’জনকে আটক করা হয়েছে। তারা সম্পর্কে বাবা-ছেলে।” তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম-পরিচয় অবশ্য জানাতে চায়নি পুলিশ। |