ভ্যানের ঝাঁকুনি খেতে খেতেই গলায় যদ্দূর সম্ভব লাস্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন রেখা।
এসো না, এসো না
তোমায় রাঁচির হুড্রু ফল্স দেখাব
তোপচাঁচি লেকে চান করাব
তুমি আমার, আমি তোমার...
টাটায় সবুজকল্যাণ সংঘের মাঠে ‘ভিখারি ঈশ্বর’-এর পালায় ঝিলমিলের গানটা দারুণ জমেছিল। বেলদায় ‘জ্বলছে চিতা, বাজছে সানাই’-এর ঝিলিকের পার্টেও সেই গানটা চালিয়ে দিলে কেমন হয়?
পিক আপ ভ্যানের ডালায় চড়ে শরতের মিঠে রোদ আর মিঠে লাগে না। তাড়া তাড়া কাগজ উল্টে তখন চার-পাঁচ রাতের পার্ট ঝালিয়ে নেওয়া চলছে। সপ্তমীর ‘অচল পয়সা’র পরে অষ্টমীতে ‘শহর থেকে বউ এনেছি’। ‘আজকে বাবার ফাঁসির দিন’ করেই ‘সাত টাকার সন্তান’ কি ‘মীরার বঁধুয়া’। নবাবি আলখাল্লা-জমিদারের বাবরি চুল-ভিলেনের লং চুল ঠাসা ট্রাঙ্ক, চোঙা মাইক, অর্গান-হারমোনিয়ামের মাঝেই চেপেচুপে সওয়ার পাড়াগাঁ-র অ্যামেচার যাত্রার ‘ফিমেল’। পাঁশকুড়া থেকে ঝাড়খণ্ডের চান্ডিল পাহাড় কি চাকুলিয়া থেকে বাঁকুড়ার রাইপুর অবধি উজিয়ে আসতে কোমর টাটিয়ে একসা। সন্ধে পুইয়ে ফের রং মেখে স্টেজে ‘বই’ করতে নামা।
“প্যান্ডেলের মা-ঠাকরুন তো পাঁচ দিন এক জায়গায় ঘট হয়ে বসে। আমাদের, গাঁ-গঞ্জের ফিমেলের কোথাও থিতু হওয়ার জো নেই।” রেখা বিষয়ীর ক্লান্ত ভাঙা-স্বরে গেল-রাতের লাবণ্য উধাও। ভৈরব গঙ্গোর কালজয়ী সৃষ্টি ‘মা-মাটি-মানুষে’ এ বার সাবিত্রী করতে হল। কমবয়সী বউয়ের পার্ট। তাই নতুন জরিপাড় শাড়িখান ভাঙা হয়ে গিয়েছে। দুলে-বাগদির মেয়ে আদুরির চরিত্রে সে সুযোগ ছিল না। ‘বই’ ভেঙেছে মাঝরাতের পরে। রেখার দু’চোখ লাল টকটকে। ক্লাবঘরের মশার কামড়ে ঘুম হয়নি একফোঁটা। পাততাড়ি গুটিয়ে এর মধ্যেই অন্য বন্দরের পানে ভেসে যাওয়া।
কাছে-পিঠে ‘বই’ থাকলে অবিশ্যি একবেলা ডেবরায় ঘরে ফেরার সুযোগ মেলে। তখন ঝোপঝাড় খোঁজাখুঁজি বা ভিন গাঁয়ের লোককে বাথরুম খুলে দিতে সাধাসাধির দরকার পড়বে না। পুষ্প হালদার ঝাঁঝিয়ে বলেন, “আমাদের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে দিব্যি পার্ট করে ক্লাবের ছেলেরা। কিন্তু থাকতে দেয় মুরগির ঘরের পাশে। খেতে দেয় ছুড়ে ছুড়ে। মানুষের সম্মান দিতে জাত যাবে!”
রেখা, মিঠু, স্বপ্না, পুষ্পদেরই কি মনের বাধা কাটতে চায়! কুটুমবাড়ির লোকেদের সামনে লজ্জায় পার্ট করতে পারবেন না স্বপ্না। তালবাগিচার শোয়ে জামাইকে দেখে পুষ্পও লজ্জায় জড়োসড়ো।
পাড়াগাঁর ক্লাবে-ক্লাবে পুজোর শখের যাত্রায় তবু ‘ফিমেল আর্টিস্ট’ ছাড়া গতি নেই। জামশেদপুর বা খড়্গপুর-মেদিনীপুরের টাউনেও ডাক পড়ে। মোহনপুরের যুবকসংঘের মেম্বার, রেলের চাকুরে শ্যামল ডিহিদার বললেন, “যাত্রা করে ফাতরা লোকে কথাটা এখনও সত্যি। ফিমেলরা ছাড়া নারী-চরিত্রে অ্যাক্টিংয়ের মেয়ে গ্রামে সহজে মিলবে না।”
সে-কালে ছেলেরা মেয়ে সাজতেন। এখন অ্যামেচার যাত্রার ড্রেস কোম্পানির লটবহরের সঙ্গে ফিমেল বা নটী-বাহিনী। বেশির ভাগই দুঃখিনী। লাথি-ঝাঁটার জীবন। কেউ বা ভিলেন-মার্কা ‘লাভার’-এর হাত থেকে বাঁচতে এ লাইনে এসেছেন। বিড়িতে সুখটান দিয়ে ডেবরার মর্ডান পোশাক স্টোর্সের শ্যাম বিষয়ী বললেন, “ফিমেল চার প্রকার। সতী-লক্ষ্মী প্যাথোজ নায়িকা, আলট্রা-মডার্ন ডাকাবুকো হিরোইন আর মায়ের পার্ট। এ ছাড়া হিরোর বোন, বউদি, কাকিমা, কলগার্ল গোছের সাইড-রোল।” ড্রেস কোম্পানিতে এই জনা চারেক ফিমেল থাকা চাই। সঙ্গে ঝিমিয়ে-পড়া বইয়ের টেম্পো তুলতে অর্গান বাজানোর মিউজিক-আর্টিস্ট, গায়ক-অভিনেতা, মেকআপম্যান ইত্যাদি। বইয়ের যাবতীয় সাজ-সরঞ্জাম। এদের নিয়েই ডেবরা কি কালনার পোশাক স্টোর্স, দাঁতনের অমুক ড্রেস-ডিলার্স বা কেশপুরের তমুক সাজঘর। বাকি অভিনেতা ক্লাবের নিজেদের। দুগ্গোপুজো থেকে জষ্টির শীতলাপুজো অবধি ড্রেস কোম্পানির রাত জাগা আর ছোটাছুটির মরসুম। রেখা-মিঠুদের চরকি পাক মহালয়ার ঢের আগেই শুরু হয়েছে। বই না-হয় পুজোয় নামবে! কিন্তু ‘মুখ-মিল’ ছাড়া পার্ট হবে কী ভাবে?
বায়নায় তাই এক দিন কি দু’দিন স্পটে গিয়ে রিহার্সালের কথা থাকে। দূরের পার্টি ধরলে তা-ও শোয়ের দু’দিন আগে পৌঁছে বসে নেওয়া গেল। কিন্তু মোহনপুর, বেলদা কি ঘাটালে মুখ মেলানো হয়েছে সেই আশ্বিনের গোড়ায়। মহালয়া থেকে ফি-সন্ধেয় ক্লাবে ক্লাবে পালার শুরু। পরে আর ক্যাচিং-কম্পোজিশন রপ্ত করার সময় থাকে না। পুজোর বইয়ের এটাই ঝামেলা। রেখা বলেন, “এমনও হয়েছে, মুখ-মিলের তিন হপ্তা বাদে পার্ট করতে গিয়ে কে স্বামী আর কে চাকর গুলিয়ে ফেলেছি। চাকরকে ‘ওগো, শুনছ’ ডেকে সে এক কাণ্ড!” হঠাৎ বড় পার্টি এসে ফিমেলকে ভাঙিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে। কাঁথিতে দমকলের এক কর্মচারী বেশি টাকায় হিরোইন বুল্টিকে তুলে নিল। পোশাক স্টোরের সে-বার বিরাট ‘লস’।
উৎসবের দিনে কোলের ছেলেকে ছেড়ে থাকতেও বুক ফেটে যায়। কিন্তু সঙ্গে নিয়ে গেলে বই করা মাথায় উঠবে। পুষ্পর মনে আছে, সাজঘরে বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে দীপালি দলুই সিন-এ গিয়েছে, ছেলে হঠাৎ মা-মা করে কেঁদে উঠল। পুষ্পকেও তখন সিনে ঢুকতে হবে। ভয় দেখিয়ে কান্না থামাতে বাচ্চাটাকে পাশের গোয়ালে শিং-ওলা মোষের সামনে বসিয়ে গিয়েছিল।
পুজো এলে রেখার মনে পড়ে মায়ের কথা। পরপর তিন-চার দিন বই করে ফিরে দেখি, মা স্ট্রোক হয়ে পড়ে। তখন হিরোইন করি! আমি না-গেলে পার্টি ড্রেস আটকে রাখবে। মাকে ওই অবস্থায় রেখে ফের বই করতে যেতে হল। মায়ের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। আর এক বার, তখনও পিক-আপ ভ্যানের চল হয়নি। ঝাড়গ্রামের ধেড়ুয়ায় গরুর গাড়িতে যেতে যেতে কালো-কুচ্ছিত লোকটা আচমকা পা দিয়ে রেখার পা টিপে ইশারা করল। কনসার্টে লোকটা অর্গানে সুর তুললে রেখার বুকে ঝড় উঠত। তখনও উঠল। চার হাত এক হতে দেরি হয়নি। শ্যাম আর রেখা মিলেই ডেবরায় স্টোর খুলেছেন।
পুজো এলেই ফিমেল থেকে নারী হয়ে ওঠার সেই আবেশ মনে ফিরে আসে। আবারও। |