কিডনি প্রতিস্থাপনকে ঘিরে অসাধু চক্র রুখতে এ বার চিকিৎসকদের দায়বদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিল রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর। কিডনি দাতার নাম-ঠিকানা বা আবেদনপত্রে রোগীর সঙ্গে তাঁর উল্লিখিত সম্পর্ক যদি ভুয়ো প্রমাণিত হয়, জবাবদিহি করতে হবে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককেই। উত্তর সন্তোষজনক না-হলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, এমনকী প্রয়োজনে রেজিস্ট্রেশন বাতিলেরও সুপারিশ করা হতে পারে।
ইতিমধ্যেই ই এম বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতাল এবং সেখানকার এক চিকিৎসককে এ বিষয়ে সতর্ক করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, ওই বেসরকারি হাসপাতালে এক ব্যক্তির কিডনি প্রতিস্থাপনের অনুমতি চেয়ে দফতরে আবেদন জানানো হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী দাতার বাড়ির নাম-ঠিকানাও দেওয়া ছিল আবেদনপত্রে। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতরের প্রতিনিধিরা যাচাই করে জানতে পারেন, ঠিকানাটি ভুয়ো। স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র অসিত বিশ্বাস বলেন, “ওই হাসপাতালের বিরুদ্ধে আগেও এই ধরনের একাধিক অভিযোগ ওঠায় আমাদের দফতর বিষয়টি খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে। কোনও রকম অনিয়ম বরদাস্ত করা হবে না।” ওই হাসপাতালে অনিয়মের অভিযোগ আসার পরে কিডনি প্রতিস্থাপনের বেশ কিছু আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।
অভিযুক্ত হাসপাতালের চেয়ারম্যান অলোক রায় অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “আমরা যা করি, সবটাই নিয়ম মেনে। কোনও অভিযোগ থাকলে
স্বাস্থ্য দফতর সেটা প্রমাণ করুক।” অভিযুক্ত চিকিৎসক দিলীপ পাহাড়ীও স্বাস্থ্য দফতরের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁর কথায়, “কোন ব্যক্তি হাসপাতালকে কী ঠিকানা দিলেন, তার দায় তো সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের নয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে এগুলো করা হচ্ছে। অঙ্গ প্রতিস্থাপন যাতে সুষ্ঠু ভাবে হয়, সেই ব্যাপারে সরকারের আরও উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।”
শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া বা রেজিস্ট্রেশন বাতিলের সুপারিশ সেই উদ্যোগেরই অঙ্গ। চিকিৎসকদের একাংশ বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের একটা বড় অংশই প্রশ্ন তুলেছেন, কেউ মিথ্যা ঠিকানা পেশ করলে চিকিৎসকের পক্ষে কী ভাবে তা যাচাই করা সম্ভব? চিকিৎসক তো গোয়েন্দা নন!
এর জবাবে স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র অসিতবাবু জানান, ঠিকানার শংসাপত্রের বিষয়টিকে তাঁরা আরও জোরদার করতে চান। ইতিমধ্যেই জেলাশাসক ও মহকুমাশাসকদের চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে, কোনও এলাকার বাসিন্দা হিসেবে যে-সাধারণ শংসাপত্র দেওয়া হয়ে থাকে, সেটা এবং কিডনি বা অন্য কোনও অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য দাতার ঠিকানার শংসাপত্র যেন এক রকম না-হয়। কিডনি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে তা দানের বিষয়টি শংসাপত্রে আলাদা ভাবে উল্লেখ করতে হবে। জেলাশাসক বা মহকুমাশাসকের স্বাক্ষরিত শংসাপত্রে সেই দানের উল্লেখ আছে কি না, সেটা দেখে নেওয়াই হবে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের কাজ। স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, বেসরকারি হাসপাতালগুলির উপরে সরকারের খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই চিকিৎসকদের দায়বদ্ধ না-করে উপায় নেই।
এসএসকেএম হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক রাজেন্দ্রনাথ পাণ্ডে বলেন, “অপরাধীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশের থেকে বেশি চালাক।
তাই নতুন নিয়ম করে অপরাধ আটকানো যাবে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। তবে খানিকটা ঠেকানো অবশ্যই যাবে।”
কিন্তু চিকিৎসকের পক্ষে তো কিডনি-দাতার পরিচয় খতিয়ে দেখা সম্ভব নয়। তা হলে কিডনি নিয়ে ব্যবসা চললে তিনি দায়ী হবেন কেন? রাজেনবাবুর যুক্তি, “বেসরকারি হাসপাতালগুলি নিজেদের মুনাফার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনও নিয়ম মানছে না। কোনও একটা সিস্টেম তো থাকা দরকার। এই ব্যাপারে চিকিৎসকেরাই হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষকে চাপ দিতে পারেন। তাই চিকিৎসকের দায়বদ্ধতা থাকলে হাসপাতালও সতর্ক হবে।”
একটি বেসরকারি হাসপাতালের নেফ্রোলজিস্ট অভিজিৎ তরফদার বলেন, “কোনও ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের পক্ষে দাতার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। পরিবারের বাইরের কেউ কিডনি দিতে চাইলে আমি সেই অস্ত্রোপচার করি না। তবু সব সময়েই ভয়ে ভয়ে থাকি, পাছে কেউ পরিবারের লোক বলে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে ঠকায়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, অনেক ক্ষেত্রে সেটাই হচ্ছে।”
রাজ্যে কিডনি পাচার চক্রের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ উঠছে কয়েক বছর ধরে। কোনও ক্ষেত্রে ভুল বুঝিয়ে কিডনি সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে দেওয়া, কোথাও আবার দালালের মধ্যস্থতায় চড়া দামে কিডনি বিক্রির অভিযোগ জমা পড়েছে স্বাস্থ্য দফতর এবং পুলিশের কাছে। ওই দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহীতার ভুয়ো পরিচয় পেশের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এ ব্যাপারে কলকাতার চারটি বেসরকারি হাসপাতালকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে।” |