ঠ্যাং ধরে বডি টেনে নিয়ে
যেত, শাস্তি দিও মা দুগগা
মাধুরী দীক্ষিত ঠিক আছে। কিন্তু আমি শ্রীদেবীর ফ্যান!
আর বাংলায় সুচিত্রা সেন অ-সাধারণ। তবে নাচটা ভাল নয়। শ্রীদেবীকেই বেশি গুণবতী মনে হয়।
এক নিঃশ্বাসে বললেন মৌসুমি দাশগুপ্ত। দুপুরের ফাঁকা হলঘরে হঠাৎ হাতের মুদ্রায় ময়ূর হয়ে ওঠেন। নেচে নেচে গুনগুন করেন,
‘মোরনি বাগা মা বোলে আধি রাতমা
ছনন ছন চুড়িয়া...।’

লমহে দেখেছেন? আমার মাসির মেয়েদের সঙ্গে দেখতে গিয়েছিলাম। সোদপুর, না কালীঘাটে! পুজো এলেই বোনেদের কথা খুব মনে পড়ে। সবাই বলে, আমি একটু বেশি কথা বলি। চুপ করিয়ে দেয়। কিন্তু কত কথা জমতে থাকে।
তখন পুজোর মানেটা অন্য ছিল। ইঞ্জিন ভ্যানে পাড়াগাঁয়ের ঠাকুর দেখা, ঠিক আছে। কিন্তু কলকাতার ঠাকুর আলাদা। গড়িয়াহাট, বাগবাজার, কালীঘাট— কোথায় যাবেন, বলুন? আমি সব চিনি। এক বার গুড়াপের দুলাল স্মৃতি-সংসদ থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। খুব খাওয়ার কষ্ট হত যে! হাওড়া থেকে সোজা গড়িয়াহাট। আমার বাবা ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ছিলেন। ওঁর কত চেনা-জানা। বাবা থাকলে কী আর এই দশা হয় আমার! বাবার টাকাটা সব আত্মসাৎ করল। কিন্তু আমায় কেউ রাখবে না। তাই নিজে বাস ধরে আবার ফিরে গেলাম।
গুড়াপের হোমের দু’ধারেই প্যান্ডেল। ডান দিক ধরে হাঁটতে হাঁটতে ঘুরে বাঁ ধার দিয়ে ফিরত মেয়েরা। পুজোর দিন ক’টা রোজকার মতো ফেনা ভাত-ঘ্যাঁট-হাফ ডিম নয়। দু-এক দিন লুচিও দিত। মুক্তির স্বাদ! কিন্তু তাতে কি জ্বালা জুড়োয়?
সারা ক্ষণ ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম। লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার দেওয়ার সময়ে এলোপাথাড়ি হাতার বাড়ি চালাত।
গুড়িয়াকেও তো আমি চিনতাম। সুন্দর চেহারাটা। টল ফিগার। তবে খুব একটা কথা হত না। পার্বতী, দীপারা ওর পাশে থাকত। আমার ঘর পাল্টে দিল। দোতলা থেকে একতলায় নেমে এলাম। শুধু কি গুড়িয়া! আরামবাগের জয়িতা, দীপিকা, সরস্বতী, পতুনা, রত্না...। এমন কেউ করে, বলুন? কথায় কথায় ঠেঙিয়ে, অত্যাচার করে সুস্থ মানুষগুলোকে অসুস্থ করে মেরে ফেলল!
আরামবাগের জয়িতা বড়লোকের ঘরের মেয়ে। হিলতোলা জুতো পরে ঘরে ঢুকল। আমার সঙ্গে থাকবে। আমি তো ভাবলাম, ভালই হল। কী শিক্ষিত, ভদ্র কথাবার্তা মেয়েটার! কিন্তু মার খেয়ে খেয়ে পাল্টে গেল। দীপিকাকে আমরা টালিগঞ্জ বলে ডাকতাম। টালিগঞ্জের মেয়ে। ও-ও কী ভাল ছিল! শ্যামল এসে সবাইকে শেষ করে দিল।
শ্রীদেবীর নাচ থেমে গিয়েছে অনেক ক্ষণ। ফর্সা মুখে নাকের পাটায় লালচে আভা। সন্ধের পরে ওই শ্যামলই একা থাকত। খেতে দিত। আর..। কত জনের সর্বনাশ করেছে! বাইরে থেকেও ছেলেরা ঢুকত। পাখা চলত না, তবু পাখা সারাতে আসত। কী হত, সবাই জানে। আমারও গায়ে হাত দিতে গেস্লো। পারেনি।
হলঘরে অনেকগুলো ছায়া। মৌসুমির পাশটিতে জড়ো হয়েছেন পনপতিয়া, দীপা, মিস্ বেবি, সলমা, রেণুকাদি...। মাঝে মাঝেই দেখতাম ঠ্যাং ধরে টেনে বডি নিয়ে যাচ্ছে। বেডকভারে ঢেকে গাড়িতে তুলছে। গুড়িয়া পালাতে চেয়েছিল। পারেনি।
গলায় দড়ি দিতে গিয়েছিল। ধরা পড়ে যায়।
ট্যাংরার মেয়ে দীপা। বলে উঠলেন, এক দিন সে কী বিকট গন্ধ, দাদা! আমরা কেউ ভাত খেতে পারছি না। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি, গুড়িয়ার পেট ফুলে ঢোল। মাটি খুঁড়ছে। গুড়িয়াটাকে ওখানেই পুঁতে দিল।
বেঁটেখাটো রেণুকাদি অঝোরে কাঁদেন। যা দেখেছি, আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না ভাই। কী অত্যাচার! ওই বড়দা, উদয়চাঁদ আর ম্যানেজার শ্যামলকে পুলিশ ধরেছে বেশ করেছে। মা দুর্গা ওদের শাস্তি দাও!
গুড়াপের মেয়েদের সব এ দিক-ও দিক পাঠিয়ে দিয়েছে সরকার। জাঙ্গিপাড়ার জনশিক্ষা প্রচার কেন্দ্রের হোমেই ৪১ জন। এক ধাক্কায় আবাসিক বেড়ে ডবল। দুঃস্থ মেয়েদের পুনর্বাসনে সরকারি প্রকল্প নিয়ে মিটিং হচ্ছে অনেক কাল বাদে। হোমে তিন বছরের বেশি থাকার কথা নয় কারও। তাতে কী? কে নেবে? পুজো আসে, পুজো যায়! বায়না না-মেলা কুমোরটুলির ঠাকুরের মতো পড়েই থাকেন ওঁরা কয়েক জন।
সল্টলেকের সুনীতা। দাদা নিল না জানেন! পুজোর ছুটিতে বউদিকে নিয়ে নৈনিতাল গেল। আমায় চুড়িদার দিয়েই খালাস।
এন্টালির জয়ন্তী। আমার দাদার পাঁচতারা হোটেলের চাকরি। একটা খবর দেবেন! বাড়ি ঘুরে আসি একটু।
পুজোর ছুটির হোম। ফাঁপরে পড়েছেন কর্ণধার অসীম মুখোপাধ্যায়। আমাদের ছোট হোম, দাদা! তার উপরে টাকা আসে না, মাসের পর মাস! কোথায় পাঠাব? কী কাজ শেখাব ওদের? পুজোয় তবু নতুন কাপড় দিই। ভ্যানে করে একটু আশপাশে ঘুরিয়ে আনি। সীতাপুরের হুটপাট সংঘ। প্রসাদপুর, কাপড়পুরের মেলা। ফুচকা, জিলিপি খায়।
গুড়াপের বেশির ভাগ মেয়েরই মাথার ঠিক নেই। তাই ঠাকুর দেখাতেও ভয়। যদি অঘটন ঘটে! পালায়?
তদন্তেও তো দরকার মেয়েদের। পুলিশ আসে! কোর্টে সাক্ষী দিতে নিয়ে যায়। তাই সাবধানের মার নেই। পাড়ার লোকেরও উঁকিঝুঁকির ভয়। পনপতিয়া, দীপাদের ঘরের জানলা তাই বন্ধ দিন-রাত।
পনপতিয়া ঘ্যানঘ্যান করেন, আমি তো পাগল নই। বাড়ি যাব। হোমে পড়ে থাকব না! আমার হাজব্যান্ড ফির শাদি করেছে। আমি কবে ঘর পাব? রাঁধতে পারি, ঝাড়াপোঁছা সব। উমর খুব বেশি হয়নি, দাদা। পঁয়তিস সাল।
ঘুপচি ঘরে আলো জ্বলছে দিনের বেলায়। পুজোর রোদ ঢুকতে পারে না। গুড়িয়া, পনপতিয়া, মৌসুমিদের জীবনে বোধন নেই। ফাঁকা হলঘরে তবু এসে দাঁড়ায় শ্রীদেবী-সুচিত্রা সেন। নেচে ওঠে কাঠামোটা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.