ডান হাতটা প্রায় অকেজো। শুধু বাঁ হাতটাই নিজের বশে। এমন ছেলে দুর্গা প্রতিমা তৈরি করতে চাওয়ায় ভ্রূ কুঁচকেছিলেন পুজো উদ্যোক্তারা। শঙ্কা ছিল, পারবে তো ও? ছেলেটা বলেছিল, “এক বার সুযোগ দিন। আপনাদের মাথা হেঁট হতে দেব না।”
ওর বাপ-দাদার হাতে গড়ে ওঠা দুর্গাপ্রতিমা বছরের পর বছর বিষ্ণুপুরের ময়রাপুকুর সর্বজনীনের মণ্ডপ আলো করে রাখত। দশর্কদের প্রশংসাও মিলত। ওই দুই মৃৎশিল্পীর মৃত্যুর পর কুমোরটুলি থেকেই প্রতিমা আনছিলেন তাঁরা। তাই বিষ্ণুপুরের বৈলাপাড়ার শান্তিনাথ পালের প্রস্তাব শুনে তাঁরা কিছুটা চিন্তায় পড়েন। শেষমেশ অবশ্য শান্তিলালই বরাত পান। |
বছর খানেক আগে কাঠের কাজ করার সময় দুর্ঘটনার পর থেকে ডান হাতের আঙুলগুলো নড়াতে পারেন না বছর আঠাশের শান্তিলাল। এরপর বাঁ হাতে সমস্ত কাজ করা অভ্যাস শুরু করেন তিনি। তাঁর কথায়, “নতুন করে জীবন শুরু বলতে পারেন।” ফিরে আসেন বর্তমানে। এক মুখ হেসে বললেন, “দেবী এ বার গজে আসছেন। সেই মূর্তিই গড়ছি। বাবা-দাদার কাজ তো দেখেছেন। আমার প্রথম কাজ, ঠিক পারছি তো?” শান্তিলাল একাই প্রতিমা গড়ছেন। সহযোগী কেউ নেই। ছেলে স্কুলে পড়ে। স্ত্রী ছায়াদেবী হেঁসেল নিয়েই থাকেন। পুজো কমিটির অন্যতম সম্পাদক গৌরাঙ্গ সাহা বলেন, “একে প্রতিবন্ধী। তার উপর প্রথম কাজ। একটু উদ্বেগে ছিলাম ঠিকই। শান্তিলাল দিন-রাত পরিশ্রম করে প্রতিমা তৈরির কাজ প্রায় শেষ করে আনায় স্বস্থি বোধ করছি।”
স্বস্থিতে শান্তিলালও। ৬ বছর আগে বাবা দুঃখভঞ্জন ও ৪ বছর আগে দাদা কাশীনাথ মারা যাওয়ার পরে ওঁদের বাড়ি থেকে ঠাকুর তৈরির চল উঠে গিয়েছিল। কিন্তু ফি বছর কাশফুল ফুটলে আর মহালয়ার ভোরে রেডিওটা বেজে উঠলেই তাঁর মন খারাপ হয়ে যেত। মনে পড়ত— কত বার এই সময়ে বাবা-দাদাকে কাঠামো বাঁধতে সাহায্য করেছেন, ওঁদের হাতে মাটির ডেলা এগিয়ে দিয়েছেন। নিজে অবশ্য ঠাকুর গড়েননি। তা বলে কি রক্তে মৃৎশিল্পীর গুণ নেই? শান্তিলাল প্রশ্নটা করেছিলেন নিজেকেই। ডান হাতের শক্ত হয়ে যাওয়া আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়ে হয়ত আমন মনে বলেও ছিলেন, “কিরে তোরা সাথ দিবি তো?” শান্তিলাল এখন বলছেন, “ডান হাতের ‘সার্পোট’ নিয়েই তো কাজ করছি। সপ্তমীর সকালে এসে দেখবেন, মা হাসছে।’’ |