দু’দশকের লড়াই শেষে চাকরি পেলেন অপর্ণা
টিচার্স রুমে ঢুকতেই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন সহশিক্ষিকারা। এগিয়ে দিয়েছিলেন চেয়ার। সেখানে বসেই মস্ত বড় টেবিলে দু’হাত রেখে চশমাটা খুলে ফেলতে হয়েছিল। কান্না সামলাতে পারছিলেন না করিমপুরের উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সদ্য নিযুক্ত শিক্ষিকা অপর্ণা নাথ। ২১ বছর ধরে এই সময়টার অপেক্ষা করছিলেন তিনি।
নদিয়ার করিমপুরেরই আনন্দপল্লির বাসিন্দা অপর্ণাদেবী সেই ১৯৯১ সালে এই স্কুলে চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিলেন। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পরে সেই চাকরি তাঁর হল গত মঙ্গলবার। যখন তাঁর বয়স প্রায় ৫৪। অপর্ণাদেবীর কথায়, “তখন চাকরিটা খুবই দরকার ছিল। ভাইরা পড়াশোনা করছিল। বাবা ছোটখাট ব্যবসা করতেন। কোনওমতে সংসার চলত। এখন ভাইরা নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ায় সংসার কিছুটা সচ্ছল। তবু আমার বাকি জীবনটার একটা ভরসা হল।”
সে বছরের কথা এখনও স্পষ্ট মনে রয়েছে তাঁর। স্কুল সার্ভিস কমিশন তখন হয়নি। ইংরেজিতে ভাল এমন এক শিক্ষিকা খুঁজছিল এই স্কুল। কর্মবিনিয়োগ কেন্দ্র থেকে স্কুলের কাছে আরও কয়েকজনের সঙ্গে অপর্ণাদেবীর নামও পাঠানো হয়। অপর্ণাদেবীও সেই ভাবেই খবর পেয়ে যান ইন্টারভিউ দিতে। প্যানেলে তাঁর নাম দ্বিতীয় স্থানে ছিল।
২১ বছর আগের অপর্ণা আজ (ডান দিকে)।—নিজস্ব চিত্র
অপর্ণাদেবী বলেন, “কিন্তু আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, যিনি প্রথম হয়েছিলেন তাঁর বয়স ৩৫ পেরিয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষিকা পদে চাকরি পাওয়ার সর্বোচ্চ বয়স তিনি পেরিয়ে গিয়েছিলেন। আমি তাই স্কুলে সে কথা জানিয়ে আমাকেই চাকরিটি দেওয়ার আবেদন করি। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি হননি। বাধ্য হয়েই আমাকে তখন মামলা করতে হয়।”
প্রথমে তিনি মামলা করেন কৃষ্ণনগর নিম্ন আদালতে। তারপরে তা ধাপে ধাপে গড়ায় হাইকোর্ট পর্যন্ত। তবে এই ক’বছরে স্কুল কর্তৃপক্ষও বদলে গিয়েছে অনেকটা। স্কুলের পরিচালন সমিতি এখন কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের হাতে। পরিচালন সমিতির সম্পাদক কাজল ভৌমিক বলেন, “তখন কেন স্কুল কর্তৃপক্ষ অপর্ণাদেবীকে চাকরি দিতে রাজি হননি, তা বলতে পারব না। সেই পরিচালন সমিতির কেউই এখন আর নেই। তবে এত দিন ধরে মামলা চলছিল। তাতে কারও কোনও লাভ হচ্ছিল না। তাই সম্প্রতি আমরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, স্কুল আর মামলা চালাবে না। তাতে ওই মহিলার যেমন ভাল হল, তেমনই আমরাও এক জন শিক্ষিকা পেলাম।”
অপর্ণাদেবী নিয়োগপত্র পেয়েছেন সোমবার। জেলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিদর্শক বিশ্বজিৎ বিশ্বাস জানিয়েছেন, হাইকোর্টের নির্দেশেই তাঁরা অপর্ণাদেবীকে নিয়োগপত্র দিয়েছেন। স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা ইন্দ্রাণী শিকদারের কথায়, “আমাদের স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ২২০০। সেখানে শিক্ষিকা মাত্র ২৯ জন। স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা পাশ করে অনেকে যোগ দিয়েছেন। তবু অনেক পদ খালি পড়ে রয়েছে। তাই অপর্ণাদেবী আসায় আমাদের খুবই লাভ হল।”
স্কুলে তাই সত্যিই নিজের বাড়ির মতোই অভ্যর্থনা পাচ্ছেন তিনি। বাঁ দিকের চোখে কিছুই দেখতে পান না। তবু স্কুলের সব কাজেই এখন সাগ্রহে হাত লাগাচ্ছেন অপর্ণাদেবী।
মনে পড়ে যাচ্ছিল, মামলা চলার সেই দিনগুলোর কথা। অপর্ণাদেবীর বাবা রবীন্দ্রকুমার নাথ বলেন, “মামলার খরচ ছিল যথেষ্টই। কিন্তু আমরা বরাবরই স্বপ্ন দেখতাম, এই চাকরিটা অপর্ণা পাবে। তাই প্রচণ্ড সাংসারিক টানাপোড়েনের মধ্যেও এই মামলার খরচ আমরা দিয়ে গিয়েছি।” অপর্ণাদেবী বলেন, “মা বলত, তুই ঠিক এই চাকরি পাবি। সে কথা সত্যি হল। কিন্তু মা চলে গিয়েছেন তিন বছর।”
অপর্ণাদেবীর জীবন থেকেও ঝড়ে গিয়েছে ২১টা বছর। বিয়ে করেননি। তাঁর কথায়, “নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে করব না, এমন একটা পণ করেছিলাম নিজের কাছেই। কিন্তু যখন চাকরি পেলাম, তখন আর বিয়ের দরকার নেই।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.