শিল্পের জন্য সরকার জমি অধিগ্রহণ না করিলে তাহার কুফল কী কী, তাহা এক্ষণে প্রায় কাণ্ডজ্ঞানের পর্যায়ে পৌঁছাইয়াছে। যাঁহারা এখনও বুঝেন নাই, অথবা যাঁহারা রাজ্যের স্বার্থরক্ষা অপেক্ষা ব্যালট বাক্সে দলের স্বার্থরক্ষাকেই কর্তব্যজ্ঞানে বুঝিবেন না বলিয়া পণ করিয়াছেন, তাঁহাদের বাদ রাখিলে দেশের ১২৫ কোটির সেই কাণ্ডজ্ঞান আছে। কাজেই, কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রিগোষ্ঠী যখন বহু বিলম্ব, বহু অজুহাতের পর শেষ পর্যন্ত জমি অধিগ্রহণ বিল (ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিসেটেলমেন্ট বিল ২০১১) চূড়ান্ত করিল, তখন দেশবাসী স্বভাবতই ঈষৎ আশান্বিত হইয়াছেন। কুনাট্য থামিলে আশা স্বাভাবিক। তবে, বিলটি চূড়ান্ত খসড়াতেও অসম্পূর্ণ। মন্ত্রিগোষ্ঠী জানাইয়াছে, প্রয়োজন বোধে সরকার ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত জমি অধিগ্রহণ করিতে পারে। এই সংখ্যাটির মাহাত্ম্য কী, মন্ত্রিগোষ্ঠী বা সরকার জানায় নাই। কেন মোট জমির এক-তৃতীয়াংশের অধিক সরকার অধিগ্রহণ করিতে পারিবে না? যে আশঙ্কা হইতে সরকারের জমি অধিগ্রহণের অধিকার স্বীকৃত হইয়াছে, ৩৩ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমা সেই আশঙ্কাটি নির্মূল করিতে পারিবে না। বরং, জমির বাজারে যাহারা ফাটকা খেলিতে উদ্গ্রীব, তাহারা স্পষ্ট জানিবে, একটি নির্দিষ্ট সীমার বাহিরে সরকারের হাত-পা বাঁধা। ফলে ফাটকার প্রবণতা এবং তীব্রতা দূর হইবে না।
যখন বাজার কুশলী ভাবে কাজ করে এবং প্রতিযোগিতার শর্তগুলি বাজারে পালিত হয়, তখন অধিগ্রহণে সরকারের ভূমিকা না থাকাই বাঞ্ছনীয়। ভারতের জমির বাজার বিবিধ কারণে তেমন নহে। কথাটি সরকারও বিলক্ষণ জানে। ভারতের দুর্ভাগ্য, এই দেশে অর্থনীতির যুক্তি কখনও রাজনীতির ঊর্ধ্বে ঠাঁই পায় নাই। ফলে, মন্ত্রিগোষ্ঠী সরকারের হাতে ৩৩ শতাংশের বেশি অধিগ্রহণের ক্ষমতা রাখিতে ভরসা পায় নাই। পাইলে, প্রয়োজনে ১০০ শতাংশ জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতাই সরকারের হাতে থাকা বিধেয় ছিল। সরকারের হাতে অধিগ্রহণের ক্ষমতা থাকা আর বিনা প্ররোচনাতেই পুলিশ-ক্যাডার (বা, পরিস্থিতিভেদে ভৈরব) পাঠাইয়া সেই জমি দখল করায় ফারাক আছে। বিলে যথেষ্ট ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে। দেশের প্রায় কোনও জমি হইতেই দীর্ঘমেয়াদে এই ক্ষতিপূরণের অঙ্কের সমপরিমাণ আয় করা সম্ভব নহে। জমির মালিক, এবং জমির উপর নির্ভরশীল মানুষের সহিত আলোচনা করিতে হইবে। তাঁহাদের লাভ-ক্ষতির অঙ্ক বুঝাইয়া বলিতে হইবে। অনুমান করা চলে, বিষয়বুদ্ধি থাকিলে কেহ জমি বেচিতে অরাজি হইবেন না। তবুও কেহ যদি ভিন্ন কোনও কারণে বা ভবিষ্যতে আরও বেশি দরের প্রত্যাশায় জমি বেচিতে অরাজি হন, এবং তাঁহার জমিটি যদি প্রস্তাবিত প্রকল্পের জন্য অপরিহার্য হয়, তবে সরকারকে সেই জমি অধিগ্রহণ করিতে হইবে বইকি। প্রয়োজনে প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করিয়া। প্রয়োজনে ১০০ শতাংশ জমির ক্ষেত্রেই এই পন্থা অবলম্বন করিয়া।
এই বিলটি কেন্দ্রীয় সরকার পেশ করিল। আইনে পরিণত হইলে সেই আইন ব্যবহারের অধিকার কিন্তু রাজ্যের হাতে থাকিবে। অর্থাৎ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইচ্ছা করিলে এই আইন না-ই মানিতে পারেন। তিনি জেদ ধরিতে পারেন, তাঁহার রাজ্যে উৎসাহী শিল্পগোষ্ঠীকেই জমির জোগাড় করিতে হইবে, সরকার কুটোটিও নাড়িবে না। তবে তাহার ফল কী হইবে, সেই কথাটিও এক বার ভাবিলে ভাল। এমনিতেই পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের ভীতির শেষ নাই। মুখ্যমন্ত্রী গত দেড় বৎসরে সেই ভীতি তিলমাত্র কমাইতে পারিয়াছেন, এমন কথা বলিলে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটও হাসিবে। ব্যবসায়ীরা অন্য রাজ্যে যাইতেই উৎসাহী। এখন সেই রাজ্যগুলিতে তাঁহাদের জমি-সমস্যার সমাধান অপেক্ষাকৃত সহজে হইবে। পশ্চিমবঙ্গ হইতে মুখ ফিরাইয়া থাকিবার আরও একটি কারণ। ধরিয়া লওয়াই যায়, এই রাজ্যে আর শিল্প আসিবে না। মুখ্যমন্ত্রী কোন পথে মা-মাটি-মানুষের জন্য উন্নয়নের স্রোত বহাইবেন, তাহাই দেখিবার। পারিলে, তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করিবেন। আর না পারিলে, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস হইয়া যাইবে। |