কেউ ব্যস্ত ঢাকের চামড়ায় টান দিতে। কেউ ধুলো ঝেড়ে ঢাকের গায়ে রংবাহারি পালক লাগাতে। কয়েক জন আবার ব্যস্ত মহড়ায়। পুজোর তিন দিন আগেও বেশ ব্যস্ত মন্তেশ্বরের শুশুনিয়া পঞ্চায়েতের কালুই গ্রামের দাসপাড়া। রাত পোহালেই অবশ্য আর এই দৃশ্য থাকবে না। পাড়া হয়ে যাবে সুনসান। পুজোর মরসুমে আশপাশের সব এলাকা যখন আনন্দে ভাসবে, দাসপাড়া তখন উৎসব শেষের অপেক্ষায় থাকবে। তার পরেই যে উপার্জন সেরে ঘরে ফিরবেন কর্তা। দাসপাড়ার ঢাকি পরিবারগুলি তো উৎসবে মাতবে তখনই।
মন্তেশ্বরের এই কালুই গ্রাম ঢাকিদের গ্রাম হিসেবে পরিচিত। মূলত গ্রামের দাসপাড়ায় বংশানুক্রমে বাস ঢাকিদের। এ পাড়ায় প্রায় ৫০টি পরিবার থাকে। প্রতি বাড়িতে গেলেই ঢাকের দেখা মেলে। কোনও বাড়িতে একটি, কোথাও একাধিক। বছরভর ঢাকিদের তেমন চাহিদা না থাকায় অনেকেই খেতমজুরের কাজ করেন। অনেকে নিজের সামান্য জমিতে চাষবাস করেন। পুজোর মাসখানেক আগে থেকে অবশ্য চিত্রটা পাল্টে যায়। |
শুরু হয়ে যায় শিল্পে শান দেওয়া। ঝেড়েঝুড়ে বার করা হয় তুলে রাখা ঢাক। নতুন নতুন বোল তুলতে চলে মহড়া। পুজোর দু’দিন আগে থেকেই পাড়া ফাঁকা হতে শুরু করে। রুজির টানে বেরোতেই হয়, তাই পরিবারের সঙ্গে পুজো কাটানো কোনও বছরেই হয় না এই ঢাকিদের। সেই দুঃখ বুকে চেপেই ঢাক কাঁধে রাজ্যের নানা জায়গা, এমনকী ভিন্ রাজ্যেও পাড়ি দেন ঢাকিরা। কার্যত পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে পাড়া। কেউ ফেরেন কালীপুজোর পরে, অনেকে আবার জগদ্ধাত্রী পুজো শেষে।
এলাকার বাসিন্দারা জানান, এ বার ঢাক বাজাতে গ্রাম ছাড়ছেন প্রায় ৭০ জন। তাঁদের সঙ্গে প্রায় সমসংখ্যক কাঁসিবাদক থাকবেন। গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মহড়ায় ব্যস্ত বিধান দাস, আনন্দ দাসেরা। তাঁরা বলেন, “পুজোর মরসুমে আমাদের এক-এক জনের পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা করে লাভ হয়। আমরা গরিব মানুষ। কোনও মতে সংসার চলে। এই রোজগারটুকুর জন্য সারা বছর মুখিয়ে থাকে গ্রামের অনেকেই। আমরা ফেরার পরে বাড়ির লোকজনের জন্য জামাকাপড় কেনা হয়। আমাদের আনন্দ শুরু হয় তখনই।” আর এক ঢাকি নিধিরাম দাস বলেন, “মণ্ডপে ঢাক বাজাতে বাজাতে যখন দেখি নতুন জামাকাপড় পরে মানুষজন পুজো দেখতে এসেছেন, মনটা খারাপ হয়ে যায়। ছেলেমেয়ের কথা বড় মনে পড়ে।” কিন্তু বেশিক্ষণ মন খারাপ করে থাকা জো নেই, রোজগারের জন্য ঢাকে মন দিতেই হয়। নিধিরামবাবুর কথায়, “বাড়ি ফিরে ছেলেমেয়ের হাতে নতুন জামাকাপড় তুলে দিতে হলে এটুকু কষ্ট তো করতেই হবে।”
ঢাকিরা জানান, তাঁদের কেউ কেউ বাড়ি ফেরেন দুর্গাপুজোর পরেই। তবে অনেকেই ফেরেন একেবারে কালীপুজো শেষে। কয়েক জন অবশ্য জগদ্ধাত্রী পুজোও সেরে আসেন। পাড়ার বধূ পূর্ণিমা দাস বলেন, “সার দিয়ে হেঁটে বাড়ির কর্তারা যখন গ্রাম ছাড়ে, খুব কষ্ট হয়। পুজোয় আনন্দ করার ইচ্ছে চলে যায়। প্রত্যেক পরিবারই তখন মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা করে, ঘরের লোক যেন সুস্থ ভাবে ঘরে ফেরে।” নিজেরা ঢাক বাজালেও পরবর্তী প্রজন্ম এই পেশায় আসুক, চান না অধিকাংশ ঢাকিই। উৎসবের দিন বাড়িতে বাড়িতে যখন আনন্দের রেষ, নিজেদের ঘরে তখন বিষাদের ছায়া আর দেখতে চান না তাঁরা। |