দ্রুত শুরু হচ্ছে রক্তক্ষরণ, বিপদ ডেঙ্গির নতুন ধরনে
পুজোর মুখে নতুন বিপদ। নাম তার হেমারেজিক ডেঙ্গি।
গত তিন মাস ধরে যে ডেঙ্গি কলকাতা ও সল্টলেকবাসীকে ভোগাচ্ছিল, তা ছিল সাধারণ ডেঙ্গি। কিন্তু তার সংক্রমণের তীব্রতা অত্যধিক বেশি হওয়ায় গোটা পরিবার ওই রোগে আক্রান্ত হচ্ছিল। সেই সংক্রমণ কিছুটা স্তিমিত হয়ে এলেও, বার শহরে হানা দিয়েছে হেমারেজিক ডেঙ্গি। যা চিকিৎসকদের কাছে উদ্বেগের বিষয়।
হেমারেজিক ডেঙ্গির আক্রমণে ২০০৫ সালে কলকাতায় মৃত্যু হয়েছিল ১২ জনের। কিন্তু সেই হেমারেজিক ডেঙ্গির সঙ্গে এ বারের হেমারেজিক ডেঙ্গির স্পষ্ট পার্থক্য দেখছেন চিকিৎসক ও গবেষকেরা। কী রকম? পরজীবী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অমিতাভ নন্দী জানাচ্ছেন, “প্রাথমিক অবস্থাতেই ডেঙ্গির এত খারাপ রোগী আগে দেখিনি। প্রতিটি রোগীকেই হাসপাতালে ভর্তি করাতে হচ্ছে। চিকিৎসা শুরু করার আগেই রোগীর মলদ্বার দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে।”
চিকিৎসক প্রবীর বিশ্বাস বলেন, “গত তিন মাস ধরে ডেঙ্গি রোগীর চিকিৎসা করছি। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে যে সব রোগী আমার কাছে আসছেন, তাদের উপসর্গ দেখে আমি বিস্মিত। জীবাণু শরীরে ঢোকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রোগীর মলদ্বার দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। প্লেটলেট কমে হচ্ছে ৮ থেকে ১০ হাজারে। রোগীকে সাত তাড়াতাড়ি হাসপাতালে দিতে হচ্ছে। প্লেটলেট দিতে হচ্ছে।”
রক্ত পরীক্ষায় এনএস-ওয়ান পজিটিভ হলে এত দিন শহরের চিকিৎসকেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাড়িতে রেখেই বেশি করে ওআরএস খাওয়ানোর পরামর্শ দিতেন। ওষুধ বলতে শুধু প্যারাসিটামল। প্রতিদিন প্লেটলেটের সংখ্যা পরিমাপ করতে বলা হত। প্লেটলেট দ্রুত নেমে যাওয়া আটকানো যেত। কিন্তু এখন প্লেটলেট নামার জন্য সময় দিচ্ছে না ডেঙ্গি ভাইরাস। প্রবীরবাবু বলেন, “এনএস-ওয়ান পজিটিভ হওয়ার এক-দু’দিনের মধ্যেই মলদ্বার দিয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হচ্ছে। মনে হচ্ছে এ এক নতুন ধরনের হেমারেজিক ডেঙ্গি।”
অমিতাভবাবু বলেন, “এনএস-ওয়ান পজিটিভ ধরা পড়ার পরে চাকা চাকা দাগ হল না চামড়ায়। এত তাড়াতাড়ি কী ভাবে মলদ্বার দিয়ে রক্ত বেরোতে শুরু করল, প্লেটলেট ১০ হাজারে নেমে গেল, তার কোনও ব্যাখ্যা আমাদের কাছে নেই। কলকাতার দক্ষিণ প্রান্ত থেকে এ ধরনের বেশি রোগী আসছে। আর আসছে হাওড়া ও মেদিনীপুর থেকে। রোগটা এখন কলকাতার অন্য দিকে এবং জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে বলেই মনে হচ্ছে।”
কলকাতার ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজ’ (নাইসেড)-এর জীবাণু বিশেষজ্ঞেরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। এক বিজ্ঞানীর কথায়, “গত তিন মাস ধরে যে ডেঙ্গিটা ছিল, তার ব্যাপ্তি বেশি হলেও তা হেমারেজিক ডেঙ্গি ছিল না। সেই ডেঙ্গির প্রকোপও কিছুটা কমে গিয়েছিল। তা হঠাৎ কী ভাবে হেমারেজিক ডেঙ্গি হয়ে ফিরে এল, তা আমাদেরও ভাবাচ্ছে।” এই ধরনের ডেঙ্গি যে এ রাজ্যেই হচ্ছে তা নয়। নয়াদিল্লি, মুম্বই, তামিলনাড়ু এবং বেঙ্গালুরুতেও হেমারেজিক ডেঙ্গি ছড়াচ্ছে বলে জানাচ্ছেন গবেষকেরা। সব জায়গাতেই এনএস-ওয়ান পজিটিভ ধরা পড়ার পরে মলদ্বার দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের খবর, মহারাষ্ট্রে চলতি মরসুমে ডেঙ্গিতে মারা গিয়েছেন ১৮ জন। দিল্লিতে ৫ জন, চেন্নাইয়ে ৬ জন এবং বেঙ্গালুরুতে মৃত্যু হয়েছে ৩ জনের। কলকাতায় এ বার ডেঙ্গিতে সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা ৭ জন।
কেন হয় হেমারেজিক ডেঙ্গি? নাইসেডের অধিকর্তা শেখর চক্রবর্তী বলেন, “হেমারেজিক ডেঙ্গির কোনও আলাদা ভাইরাস নেই। ডেঙ্গির চারটি ভাইরাসের যে কোনও একটিতেই হেমারেজিক ডেঙ্গি হতে পারে। কোনটায় সাধারণ ডেঙ্গি হবে, কোনটায় হেমারেজিক ডেঙ্গি, তা কিন্তু বোঝার উপায় নেই।”
পাশাপাশি অন্য একটি সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না শেখরবাবু। তিনি বলেন, “অনেক সময় দেখা যায় পরপর দু’রকমের ডেঙ্গি ভাইরাস ঢুকে হেমারেজিক ডেঙ্গি হচ্ছে। প্রথম যে ডেঙ্গি শরীরে ঢোকে, তার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। তার পরে নতুন প্রজাতির ডেঙ্গি ঢুকলে তার সঙ্গে ইতিমধ্যেই তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডির বিক্রিয়ায় হেমারেজিক ডেঙ্গি হতে পারে। কলকাতায় যে হেমারেজিক ডেঙ্গি এখন হচ্ছে, এটাই তার কারণ কি না তা অবশ্য বলা সম্ভব নয়।”
নাইসেডের জীবাণু বিজ্ঞানী প্রভাসচন্দ্র সাধুখাঁ বলেন, “গত কয়েক বছরে যারা ‘ডেং টু’ বা ‘ডেং ফোর’ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই এ বার ‘ডেং থ্রি’-তে আক্রান্ত হতে পারেন। আর সে ক্ষেত্রে শরীরে থাকা ‘ডেং ওয়ান’-এর অ্যান্টিবডির সঙ্গে ‘ডেং থ্রি’-র অ্যান্টিজেন বিক্রিয়া করে হেমারেজিক ডেঙ্গি ঘটাতেই পারে।” প্রভাসবাবু বলেন, “২০০৮ সালে আমরা কলকাতায় হাতে গোনা হেমারেজিক ডেঙ্গি পেয়েছিলাম। এ বার সংখ্যাটা অত্যধিক বেশি। সেটাই চিন্তার।”
তবে মশাবাহিত রোগ এ ভাবে ছড়িয়ে পড়ায় চিকিৎসক বিশেষজ্ঞেরা কিন্তু দায়ী করছেন মানুষকেই। কারণ, বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও যেমন জল জমিয়ে রাখা কমছে না, তেমনই মশারিতে শোওয়া রপ্ত করতে পারেননি শহরবাসীর অনেকেই। তাই ডেঙ্গির সঙ্গে ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যাও বেড়েই চলেছে বলে জানাচ্ছেন অমিতাভবাবু। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ফ্যালসিপেরাম ছড়াচ্ছে বেশি। ডেঙ্গি রোগী আক্রান্ত হচ্ছেন ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড কিংবা চিকেন পক্সে। তাতে জটিলতা বাড়ছে। চিকিৎসকেরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন।”

হেমারেজিক ডেঙ্গি কী?
এই ডেঙ্গিতে মাড়ি, ত্বক, মলদ্বার বা মূত্রনালি দিয়ে রক্তপাত হয়
কেন হয় হেমারেজিক ডেঙ্গি?
যে কোনও ডেঙ্গি ভাইরাস থেকেই হয়। আক্রান্তের শারীরিক অবস্থার উপরে নির্ভরশীল।
পরপর সংক্রমিত দু’ধরনের ডেঙ্গি ভাইরাসের বিক্রিয়াতেও হতে পারে
যার কোনও ব্যাখ্যা নেই
• ধরা পড়ার দু’দিনের মধ্যেই মলদ্বার দিয়ে রক্তপাত
• প্লেটলেট হঠাৎ নেমে যাচ্ছে ৮ থেকে ১০ হাজারে
• গা-হাত-পায়ে ব্যথা নেই, র্যাশ নেই, তবু ডেঙ্গি
• ২০০৫-এর থেকে হেমারেজিক ডেঙ্গির রোগী বেশি



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.