প্রতিবাদ গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বিশেষত, রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কাজেই, স্থানীয় তৃণমূল-সিপিআইএম বিসম্বাদের জেরে এক নাট্যকর্মীকে যখন সরকারি রোষের সম্মুখীন হইতে হয়, সমাজ তাহার প্রতিবাদ করিবে, তাহাই প্রত্যাশিত। সরকার যখন রাজধর্ম হইতে বিচ্যুত হইয়া প্রতিশোধের খেলায় মাতে, তখন সরকারকে তাহার স্খলন বিষয়ে সচেতন করাইয়া দেওয়া, রাজধর্মে ফিরিতে চাপ সৃষ্টি করা সমাজের কর্তব্য। সমাজে যাঁহারা ‘বিদ্বজ্জন’ হিসাবে স্বীকৃত, এক অর্থে তাঁহাদের সমাজের মাথা বলা চলে ক্ষমতার নিরিখে নহে, মেধার নিরিখে। রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদটি সমাজের মাথা হইতে আসাই স্বাভাবিক। বর্তমান ক্ষেত্রে আরও স্বাভাবিক, কারণ যিনি আক্রান্ত, তিনিও নাটকের সঙ্গে যুক্ত, সাংস্কৃতিক কর্মী। কাজেই, পশ্চিমবঙ্গের ‘বিদ্বজ্জন’-দের একটি অংশ যখন সরকারের রাজধর্মে চ্যুতির প্রতিবাদে সভায় উপস্থিত হন, তাহাতে অস্বাভাবিকতা নাই, বরং সমাজের জীবিত থাকিবার প্রমাণ রহিয়াছে। কিন্তু এই হতভাগ্য রাজ্যে কিছুই দলীয় রাজনীতির পরিসরের বাহিরে থাকিতে পারে না। বিদ্বজ্জনদের প্রতিবাদ সভাটি স্বতঃস্ফূর্ত নহে, বরং বিরোধী রাজনৈতিক দলের দ্বারা আয়োজিত, এমন কথা শোনা যাইতেছে। কথাটিকে নির্দ্বিধায় উড়াইয়া দেওয়ার মতো মনের জোর রাজ্যবাসীর আর নাই। শাসক দলও পাল্টা সভা আয়োজন করিয়াছে। সেই সভায় দাঁড়াইয়া রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী দুইটি নূতন শব্দ উপহার দিয়াছেন। সব মিলাইয়া, যাহার উদ্দেশ্য ছিল রাজনীতির বাহুল্যের বিরুদ্ধে সরব হওয়া, সেই প্রতিবাদটি রাজনীতির ঘোলা জলে নামিয়া পড়িল।
এই ঘটনাটি উদাহরণমাত্র। বিদ্বজ্জনরা কোনও একটি শিবিরে নাম লিখাইয়া রাখিবেন, পশ্চিমবঙ্গে ইহাই স্বাভাবিক গতি। শুধুমাত্র একবিংশ শতকের পশ্চিমবঙ্গের নহে, জন্মাবধি। এই রাজ্যের আদি পর্বে শিল্পী-সাহিত্যিকদের একটি বড় অংশ বামমনস্ক ছিলেন। তৎকালীন বিরোধী বাম দলগুলি শুধু এই মানসিক সমর্থনে সন্তুষ্ট হয় নাই, ক্রমে সেই বুদ্ধিজীবীদের দলীয় কর্মীতে পরিণত করিতে উদ্যোগ করিয়াছিল। শিল্পী সাহিত্যিকদের একটি অংশ সেই প্রক্রিয়ায় স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন, দলের মতবাদই তাঁহাদের শিল্পের ভাষা হইয়া উঠিয়াছিল। ১৯৭৭-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে বহু শিল্পী-সাহিত্যিকই ‘সরকারি বিদ্বজ্জন’ হইয়া উঠিয়াছিলেন। দীর্ঘ তিন দশক পরে ২০০৭ সালে প্রথম বার বোধ হইয়াছিল, এই রীতি বুঝি ফুরাইল। কিন্তু হায় পশ্চিমবঙ্গ! যাঁহারা ২০০৭ সালে বাম সরকারের অপশাসনের প্রতিবাদে পথে নামিয়াছিলেন, রাজ্যবাসী অবাক বিস্ময়ে দেখিল, তাঁহাদের একটি বড় অংশ নূতন সরকারের সভাসদ হইয়াছেন, আর কয়েক জন পুরাতন শিবিরে ফিরিয়া গিয়াছেন। রাজনৈতিক শিবিরের ছাপ বদলাইয়াছে, কিন্তু মুছে নাই। বস্তুত, বিদ্বজ্জনরাই মুছিতে দেন নাই। কেন, সেই প্রশ্নের একটি উত্তর হাওয়ায় ভাসে দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকিলে লাভ হয়। লাভ হয়তো সত্যই অনেক, ক্ষতি একটিই বিদ্বজ্জনদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর বলিয়া কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না। তাঁহারা মুখ খুলিলে শুধুমাত্র দলের গলাই শোনা যায়।
অক্টোবরের কলিকাতা যেমন প্রতিবাদ সভা-পাল্টা সভায় শুনিতেছে। বস্তুত, সেই সভাগুলিতে যে আওয়াজ শোনা যাইতেছে, তাহা একটি বদ্ধ জলাশয়ের ঘোলা জলে আন্দোলনের শব্দ। ওই ঘোলা জলটিই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি-কণ্টকিত সমাজ। তাহাতে যে আন্দোলন চলিতেছে রাজ্যবাসী সন্দেহ করিবেন তাহা নিতান্তই রাজনৈতিক সুবিধার মাছ ধরিবার চেষ্টা। এই জলে নিমজ্জিত হওয়াই রাজ্যের ভবিতব্য। রাজনীতি চলিতেছে, চলিবে তবে সরকারও যদি সেই খেলার খেলুড়ে হওয়াই মনস্থ করে, তবে আর নিস্তার নাই। দল এবং সরকার এক নহে। দলের বাহুবলীরা অন্যায় করিলে মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমাসুন্দর চক্ষে বলিবেন, ছোট ছেলেদের ছোট ভুল, অথবা কিছুই না বলিয়া অভিযোগকারীকে শাস্তি দিবেন এমন হইলে রাজ্য বাঁচিবে না। দোষীর শাস্তিবিধান প্রশাসনের কর্তব্য, তাহাদের রাজনৈতিক রঙ-বিচার নহে। মুখ্যমন্ত্রী রাজধর্মের এই প্রাথমিক পাঠটি স্মরণে রাখিতে পারেন। এবং, আপনি আচরি ধর্ম, তাঁহার শিক্ষামন্ত্রীকেও বুঝাইয়া বলিতে পারেন। |