|
|
|
|
রাষ্ট্রপতি ভবন |
চুরির ভূত তাড়াতে তৎপর প্রণব |
শঙ্খদীপ দাস • নয়াদিল্লি |
মধ্যযুগে হলে কী হুলুস্থুলই না হত! এ তো খোদ রাজবাড়িতে চুরি!
রাইসিনা হিলসের উপর যে বিশাল ভাইসরিগ্যাল হাউস, অধুনা রাষ্ট্রপতি ভবন, সে তো রাজপ্রাসাদের কম কিছু নয়! তার আদবকায়দায় আজও মোগল সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট। অথচ গত ষাট বছরে সেখান থেকেই একে একে নিঃশব্দে উধাও হয়ে গিয়েছে বহুমূল্য আসবাব, শৌখিন সামগ্রী, চিত্র ও শিল্পকার্য! শুধু তাই নয়। অভিযোগ, প্রায় আড়াই লক্ষ বর্গফুটের প্রাসাদের তিন শতাধিক ঘরে থাকা বহুমূল্য সামগ্রীর হিসেবের মধ্যেই রয়েছে বিস্তর গরমিল।
সে সব জেনেশুনে বেজায় চটেছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর সচিবলায় সূত্রে বলা হচ্ছে, ভূত ছিল সর্ষের মধ্যেই। রাইসিনা হিলসের পুরনো কর্মী, আমলাদের একাংশই সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন বহু আসবাব ও শিল্প কর্ম, এমনই অনুমান। বহুমূল্য তো বটেই, সে সব জিনিসের ঐতিহাসিক গুরুত্বও অপরিসীম। কিন্তু প্রণবের কঠোর নির্দেশ, তদন্ত-তল্লাশি করে যে ভাবেই হোক ওই সব আসবাব ও শিল্পকার্য ফিরিয়ে আনতে হবে রাষ্ট্রপতি ভবনে। দরকার হলে অবসরপ্রাপ্ত কর্মী-অফিসারদের বাড়িতে খোঁজ লাগাতে হবে। তাঁর সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব গায়ত্রী কুমারকে এ ব্যাপারে তিনি স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। |
|
যামিনী রায়ের এই ছবি পড়ে ছিল অনাদরে। এখন ফের স্বমহিমায়। |
প্রণববাবুর ইচ্ছা, রাষ্ট্রপতি ভবনের মিউজিয়াম এমন ভাবে সাজানো হোক, যাতে গত প্রায় দুই শতাব্দীর ইতিহাস সেখানে মূর্ত হয়ে ওঠে। তাঁর কথায়, “রাষ্ট্রপতি ভবনের শুরু থেকে যে কত ঘটনা ঘটেছে, তার ইয়ত্তা নেই। ১৯৩১ সালে গাঁধী-আরউইন চুক্তি হয়েছিল এখানেই। কিন্তু মুশকিল হল, যে টেবিলে বসে সেই চুক্তি হয়েছিল, তার খোঁজ পাচ্ছি না। এমনকী পেনটাও উধাও! ভাইসরয় এবং অতীত রাষ্ট্রপতিদের ব্যবহার করা বহু আসবাব নিখোঁজ। সব খুঁজতে বলেছি।”
রাইসিনায় এই নিরুদ্দেশ সম্পর্কিত ঘোষণার একটা নেপথ্য গল্পও রয়েছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের রাজনৈতিক উত্তাপ তখন গনগনে। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নাম সবে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা হয়েছে। দশ নম্বর জনপথে এক ঘরোয়া আড্ডায় সনিয়া গাঁধী বলেছিলেন, “রাষ্ট্রপতি ভবন সম্পর্কে অনেক দিন ধরেই নানা খারাপ খবর পাচ্ছি। এক সময় শাশুড়ির কাছ থেকে শুনেছি, রাষ্ট্রপতি ভবনের প্রচুর বহুমূল্য জিনিসের নাকি হদিস নেই। রাজীবও বলতেন সে কথা। আপনি রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে সে সব ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন। দেখুন, রাষ্ট্রপতি ভবনের মিউজিয়ামটা আরও ভাল করা যায় কি না।”
প্রসঙ্গত রাষ্ট্রপতি ভবনের শিল্পকার্য রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে ইন্দিরা গাঁধী খুবই যত্নশীল ছিলেন। বিদেশি অতিথি-অভ্যাগত রাষ্ট্রপতি ভবনে এলে অতিথিশালা সাজানোর ব্যাপারে তিনি নিজে তদারকি করতেন। যেমন রানি এলিজাবেথ যখন রাষ্ট্রপতি ভবনে এসেছিলেন, তখন ভবনের সংগ্রহশালা থেকে একটা বড় এচিং এনে অতিথিশালায় রাখা হয়েছিল। উইলিয়াম ড্যানিয়েলের আঁকা, জ্যোৎস্না-ঝলমলে তাজমহল সেটি রাখা হয়েছিল শয়নকক্ষে শয্যার মাথার কাছে। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন আশির দশকে প্রখ্যাত ইন্টিরিয়ার ডিজাইনার সুনীতা কোহলিকে দিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনের অন্দরমহল সংস্কারের কাজও করিয়েছিলেন ইন্দিরা।
স্বাভাবিক ভাবেই রাজনীতিতে একদা তাঁর ভাবশিষ্য প্রণব মুখোপাধ্যায়ও এখন সে পথেই হাঁটছেন। তাঁর নির্দেশে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে এরই মধ্যে যোগাযোগ করা হয়েছে সুনীতা কোহলির সঙ্গে। সুনীতার কাছেই জানা গেল, রাষ্ট্রপতি ভবনের আসবাবগুলি অনন্য সাধারণ। ভবনের প্রধান স্থপতি এডউইন লুটিয়েন্সের তত্ত্বাবধানে লাহৌরের কারিগরশালায় তৈরি করা হয়েছিল সেগুলো। পরবর্তী কালে ভাইসরয় ও তাঁর স্ত্রীদের পছন্দ অনুযায়ী কিছু আসবাবের নকশা পরিবর্তন করা হয়। কিছু নতুন আসবাবও তৈরি করা হয়। শুধু আসবাব নয়, গত ষাট বছরে বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদের উপহার দেওয়া প্রচুর শৌখিন শিল্পকার্যও রয়েছে রাষ্ট্রপতি ভবনে। বিদেশ সফরে গিয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রপতিরা যে সব উপহার পেয়েছেন, তা-ও রয়েছে। সেই তালিকাতেও গরমিলের অভিযোগ রয়েছে। ব্যক্তিগত ভাবে অবশ্য রাষ্ট্রপতি কোনও উপহার নেন না। বই ব্যতিরেকে সবই চলে যায় তোষাখানায়। সেই সব উপহার অবসরের পরেও নিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই।
অবসরের পর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল অমরাবতীর এক সংগ্রহশালার জন্য কিছু শিল্পকার্য নিয়ে গিয়েছেন বলে সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছিল। তবে রাষ্ট্রপতি ভবন সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ১৫৫টি সামগ্রী নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু অমরাবতীর ওই সংগ্রহশালা এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি ভবনের সঙ্গে এক বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ রয়েছে। এক বছর পর রাইসিনা হিলসে সেগুলি ফিরিয়ে আনা হবে। বরং প্রণবের সচিবালয়ের এক কর্তার কথায়, রাষ্ট্রপতি ভবনের অনেক আসবাব বা শিল্পকার্য অনেক রাষ্ট্রপতি নিয়ে চলে গিয়েছেন বলে অপপ্রচার চলে ঠিকই। কিন্তু সেই সব অভিযোগের কোনও বাস্তব ভিত্তি নেই। বরং রাইসিনা হিলসের কর্মীদের একাংশই সে সব সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। প্রণব এখন সেগুলিই খুঁজে বার করার নির্দেশ দিয়েছেন।
আর এরই মধ্যে ঘটে গিয়েছে গুপ্তধন আবিষ্কারের মতো একটা ঘটনা। রাষ্ট্রপতি ভবনের অতিথিশালায় থাকার সময় প্রণববাবুর সম্প্রতি নজর পড়ে যামিনী রায়ের আঁকা একটি ছবির দিকে। কিছুটা অযত্নেই রাখা ছিল ছবিটি। প্রণব-কন্যা শর্মিষ্ঠারও নজরে পড়ে সেটি। তার পর রাষ্ট্রপতি ভবনের তোষাখানা (ট্রেজারি) খুলে দেখা যায়, যামিনী রায়ের আরও প্রায় ছ’টি ছবি এবং যোগেন চৌধুরীর কিছু ছবি কাগজে মুড়ে পড়ে রয়েছে। সেগুলি উদ্ধার করে, যথাসম্ভব পরিচ্ছন্ন করে রাষ্ট্রপতির স্টাডি ও বৈঠকখানায় রাখা হয়েছে। আর একটি ঘর থেকে উদ্ধার হয়েছে হাতির দাঁতের নকশা করা একটি শিল্পকার্য। ঠিক হয়েছে, পরে এগুলো সব রাষ্ট্রপতি ভবনের সংগ্রহশালাতেই রাখা হবে।
অর্থাৎ? চুরি, গুপ্তধন, রহস্য, সন্দেহ মিলেমিশে রাইসিনা হিলসের রাজকাহিনি জমজমাট! |
|
|
|
|
|