দুর্গাপুজো মানে, আলোয় সাজানো রাস্তা। মা শবনমের ওই পাঁচ দিন চরম ব্যস্ততা। আবছা আলোর ফুটপাথে সস্তা জামা গায়ে রং মেখে দাঁড়ানো। পাশ দিয়ে চলে যাওয়া খুশিতে উচ্ছ্বল মুখগুলো আরও এক বার ঠেলে তুলত বুকে জমা যন্ত্রণাটাকে। আর এ ভাবেই তেরোটা বসন্ত পেরিয়ে এসেছিল সাবিনা।
এ বার এক অন্য পুজো সাবিনার। প্রথম বার দেখবে ও দুর্গাকে। মালিনী দিদি শোনায় মহিষাসুরমর্দিনীর গল্প। দিদি বলেন, ‘নারীশক্তির প্রতীক দুর্গা’। পরিস্থিতির শিকার না হয়েও প্রতিবাদের শক্তি পেয়েছিল সাবিনা সেই গল্প শুনেই। আলোয় ফেরার ব্যাকুলতা তাড়িয়ে এনেছিল ওকে পাশের পাড়ার মালিনী দিদির কাছে। দু’হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিয়েছিলেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার মালিনী শর্মা। তাঁরই হাতে পরম ভরসায় শবনম তুলে দিয়েছিলেন নিজের শক্তিকে।
দিদির বলা সেই আদি শক্তির গল্পে মিশছে খাদির কাহিনি। দেশ তখন পরাধীন। বিদেশি জিনিস বর্জনের ডাক দিলেন মহাত্মা গাঁধী। এগিয়ে এলেন মেয়েরা। খাদির সাথে আজও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নারীর মমতা। এ ভাবেই নারীশক্তিকে কুর্নিশ জানাচ্ছে হাতিবাগান নবীন পল্লি। মণ্ডপের প্রবেশপথ সবরমতী আশ্রমের মূল ফটকের আদলে। মণ্ডপ জুড়ে থাকছে মাকু, ববিন, সুতো আর অসংখ্য চরকা। কোলাজের মাধ্যমে তুলে ধরা হবে খাদি তৈরির পদ্ধতি। সন্তান মায়ের শক্তি। সাবেক সাজে দুর্গার ত্রিশূলে থাকবে তাঁর চার সন্তান।
চলচ্চিত্র মানে কী? জানে না সাবিনা। টিভির পর্দায় কখনও দেখেছে সিনেমা। এ বার দেখবে আলো ছায়ার খেলা। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ১০০ বছরকে স্মরণ করছে ২৫ পল্লি সর্বজনীন। লোহা আর টিনে তৈরি মণ্ডপের প্রবেশপথে বিশালাকায় দু’টি ক্যানভাস। তাতে কিছু স্থিরচিত্র। আলো ছায়ার খেলায় মায়ার জাল বুনবে ওরা।
দুর্গা আবার নাচও জানে ওর মতো! বিস্মিত সাবিনা। নৃত্যের তালে এখানে দুর্গা। মাছ ধরার ছিপ, বেতবাঁশ ও নলবাঁশে সাজছে মণ্ডপ। সৃষ্টি-স্থিতি-লয় ব্রহ্মাণ্ডের এই ত্রিকালচক্রের পূর্ণ আবর্তকে তুলে ধরছে আজাদগড় সেবক সঙ্ঘ। অন্ধকারে শৈশব হারিয়ে যাওয়া সাবিনা কোনওদিন দেখেনি গ্রাম। ছবিতেও নয়। মুক্তির যাবতীয় উপকরণ যে ওই পাড়ায় নিষিদ্ধ ছিল। এ বার দু’চোখ ভরে গ্রাম দেখবে ও। পাট আর খড়ের কারুকাজ দুর্গামণ্ডপ সাজাচ্ছে অশোকগড় সর্বজনীন। প্রতিমা সাবেকি।
মালিনী দিদি বলেন, গতি না থাকলে জীবনের কোনও দাম নেই। সাবিনাদের বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসছে ‘আবর্তনের ঘূর্ণিপাকে ধরতে হবে সময়টাকে’। ‘সময়’ নিয়ে পথ চলছে বেহালার আদর্শপল্লি সর্বজনীনের। জীবনের ছন্দে ছুটছে সময়। প্রতিমার চোখে গতির তীব্রতা। অসুর জড়তার প্রতীক। ৮০ ফুট বাই ২০ ফুট প্যানেলে খড় দিয়ে হচ্ছে গতির প্রতীক অসংখ্য চাকা ও মানুষের বিভিন্ন ত্রিমাত্রিক মডেল। প্রতিমার আটটি হাতে আট চক্র। দুই হাত ধরা রয়েছে ত্রিশূলে।
নিম্নমুখী ত্রিভুজ দেবীর প্রতীক। ঊর্ধ্বমুখী ত্রিভুজ দেবতার। মূর্তিপুজোর প্রচলনের আগে এই যন্ত্রশক্তির উপাসনাই হত। অধ্যাত্মবাদের আদি জ্যামিতিক এই ত্রিভুজাকারে সাজবে রামগড় অধিবাসীবৃন্দের পুজোমণ্ডপ ও প্রতিমা।
স্বর্গ কেমন দেখতে? জানতে সাবিনা যাচ্ছে খিদিরপুর পল্লি শারদীয়ার মণ্ডপে। স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল নিয়ে হাজির ওরা। উদ্যোক্তারা তিনটি আলাদা পরিবেশ তৈরি করছেন। থাকছে তিন ধরনের আলো ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। সাদা তুলোর মেঘে আর নীল, সাদা আলোর মিশেলে তৈরি হচ্ছে স্বর্গীয় পরিবেশ। প্রতিমা এখানে সাবেকি।
দুর্গাপুজো মানে এত কিছু! এ বার সাবিনার চোখেমুখে সেই পরিচিত খুশির ঝলক। |