২০০০ থেকে ২০১২। মঞ্চে দ্রৌপদী মেঝেন-এর বয়স হল ১২ বছর।
দিন কয়েক আগেই কলকাতায় আরও এক বার মঞ্চস্থ হল ‘দ্রৌপদী’। মণিপুরের খ্যাতনামা নাট্যপরিচালক কানহাইয়া লালের সাড়া জাগানো প্রযোজনা দেখে আরও এক বার বাকস্তব্ধ শহরের নাট্যদর্শকরা। হেইসনাম সাবিত্রীর অভিনয় আরও এক বার শিহরিত করল তাঁদের।
মহাশ্বেতা দেবীর গল্প অবলম্বনে এই নাটকেই অভিনীত হয় ভয়াবহ সেই দৃশ্য। সেনা হেফাজতে দ্রৌপদী মেঝেন-এর উপর অকথ্য শারীরিক নিগ্রহ। যার ক্লাইম্যাক্সে ঘুরে দাঁড়ান দ্রৌপদী। নিজের হাতে টেনে খুলে ফেলেন সমস্ত জামাকাপড়। সেই নগ্ন প্রতিবাদের
সামনে থতিয়ে যায় বাঘা বাঘা সেনা অফিসারের উদ্ধত পৌরুষ।
থতিয়ে যায়, বিহ্বল হয়ে যায়, লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায় দর্শকেরও। অ্যাকাডেমি মঞ্চে ষাটোর্ধ্ব সাবিত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে উঠে টানা পনেরো মিনিট স্বতঃস্ফূর্ত হাততালি। হল থেকে বেরোচ্ছে যে দর্শক, তার মাথা নিচু। অনেকেরই স্মৃতিতে এখনও দগদগে হয়ে আছে ২০০৪-এর সেই ঘটনা। মনোরমা থাংজামের ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে মণিপুরের নারীদের সেই নগ্ন মিছিল। গায়ে সাঁটা পোস্টার এসো, ধর্ষণ করো!
কলকাতার মঞ্চে গত কয়েক বছর ধরেই রাজনৈতিক নাটকের ঢল। রাজনীতি এবং যৌনতা, দুইই ইদানীং এ শহরের একাধিক প্রযোজনায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে উঠে আসছে। দ্রৌপদী আর সাবিত্রীর অভিনয় নিয়েও এই ১২ বছরে দেশ জুড়ে বহু আলাপ-আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এমন প্রযোজনা তৈরির অনুপ্রেরণা কতটা ছড়িয়েছে? দ্রৌপদীর পরিচালক কানহাইয়া লালের জবাব, “আমাকে আর সাবিত্রীকে অনেক বার প্রশ্ন করা হয়েছে, শরীরকে আমরা যে ভাবে ব্যবহার করলাম, আর কেউ সে ভাবে করল না কেন? একটাই উত্তর। আমাদের দেশে নারীবাদ নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা হয়। কিন্তু অধিকাংশই তার আসল স্পিরিটটা ধরতে পারেন না।” |
দ্রৌপদীর ভূমিকায় হেইসনাম সাবিত্রী |
অথচ দ্রৌপদী তো বাংলা গল্প! মণিপুর পারলে কলকাতা পারে না? “পারা উচিত ছিল”, বললেন সোহাগ সেন। ‘‘অস্বীকার করে লাভ নেই, মণিপুর আর কলকাতার মধ্যে মানসিকতার একটা তফাৎ আছেই। পেলব মধ্যবিত্ততা আর ভদ্রলোকিপনা আমাদের আটকে দেয়। বাঙালি বাইরের প্রযোজনা দেখে হাততালি দেয়, ঘরের মেয়ে করলে মেনে নেবে কি?” মণিপুরের রাজনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতা মনের মধ্যে যে আগুনের জন্ম দেয়, বাঙালি মধ্যবিত্তের মধ্যে তা কোথায়? সোহাগ নিজে এক বার ‘দ্রৌপদী’ করবেন ভেবেছিলেন। শেষ অবধি হয়ে ওঠেনি। “আমি করলে হয়তো শ্যাডো ব্যবহার করতাম। নইলে আমার ধারণা, নাটক বন্ধ করে দেওয়া হত।” মণিপুর আর কলকাতার পরিবেশগত পার্থক্যের উপরে জোর দিচ্ছেন কৌশিক সেনও। “কানহাইয়া লাল আর সাবিত্রীর নাট্যচর্চা আমাদের শহুরে নাট্যচর্চার চেয়ে অনেক আলাদা। সাবিত্রী যখন দৃশ্যটি করছেন, তখন মঞ্চেই দু’জন অভিনেতা উপস্থিত। ওঁদের কাছে অভিনয়ের সময় লিঙ্গভেদটাই কাজ করছে না।”
ব্রিটেনের মঞ্চে ‘ইক্যুয়াস’ নাটকে গায়ে আবরণ না রেখে অভিনয় করতে পারেন ড্যানিয়েল র্যাডক্লিফের মতো তারকা। হ্যারি পটার ভাবমূর্তির কী হবে, সে নিয়ে মাথা ঘামান না তিনি। এই ‘ইক্যুয়াস’ অবলম্বনেই কলকাতায় ১০০-রও বেশি শো হয়েছে ‘আগুনের বর্ণমালা’ নাটকের। পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য সাহসী সংলাপের মধ্যেই নিজেকে বেঁধে রেখেছিলেন। সেই অনির্বাণই স্বীকার করছেন, “যখন প্রথম ‘দ্রৌপদী’ দেখি, হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে হল থেকে বেরিয়েছিলাম। ভিতরকার একটা প্রচণ্ড শক্তি না থাকলে ওই রকম প্রযোজনা অসম্ভব।”
সেই ‘শক্তি’রই কি তবে অভাব ঘটছে কোথাও? কৌশিক বলছিলেন, “আমি এবং আমার স্ত্রী রেশমী, দ্রৌপদী দেখে আলোচনা করছিলাম যদি আমরা এই ভাবে ম্যাকবেথ ভাবতে পারতাম!” রোমান পোলানস্কির ছবিতে স্লিপ-ওয়াকিংয়ের দৃশ্যে লেডি ম্যাকবেথ কিন্তু নগ্ন। “রেশমী রাজি ছিল। কিন্তু একই সঙ্গে প্রশ্ন করেছিল, যদি আমরা করিও, ক’টা শো করতে পারব?” এই কলকাতাতেই তো অশ্লীলতার অভিযোগে আশির দশকে কলকাতায় পিনা বাউশের মতো বিখ্যাত কোরিওগ্রাফারের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এই কলকাতাই ‘ছত্রাক’-এর ক্লিপিং নিয়ে ছিছিক্কারে ফেটে পড়েছিল। প্রসঙ্গগুলো তুলে সুমন মুখোপাধ্যায় মনে করিয়ে দেন, “আমি যখন ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’য় বাঘারুকে ল্যাঙট পরিয়েছিলাম, তা নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছিল।”
অথচ এই ১২ বছরে চার বার কলকাতায় অভিনয় হল ‘দ্রৌপদী’। কানহাইয়া লাল বলেন, “আমরা কোনও চমক দিতে কিছু করিনি। একটাই উদ্দেশ্য ছিল, দর্শকের অন্তরাত্মায় ঘা দেওয়া।” প্রথম শো-তে ইঙ্গিতেই বোঝানো হয়েছিল সবটা। কিন্তু সাবিত্রীর নিজেরই মনে হচ্ছিল, দৃশ্যটা যথেষ্ট অভিঘাত পাচ্ছে না। পরের শো থেকে উনি নিজেই সিদ্ধান্ত নেন, আড়াল সরিয়ে দেবেন। কানহাইয়া লালের কথায়, “বিষয়বস্তুর প্রতি সাবিত্রীর একাত্মতাই সেটা সম্ভব করেছে।” প্রথম দিকে ইম্ফলে এই নাটক করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। “তবে কলকাতায় কখনও অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়িনি।
পুলিশি নিরাপত্তাও দরকার হয়নি।” কারণ সুমনেরই কথায়, “সাবিত্রীর বয়স, তাঁর নাট্যঐতিহ্য এবং নাটকটার রাজনৈতিক প্রেক্ষিত দ্রৌপদীকে ভুল ভাবে দেখার সুযোগই দেয় না।” আর এই উদাহরণটাই অভিনেত্রী সোহিনী সেনগুপ্তকে কিন্তু বিশ্বাস করায়, “অভিনয় যদি শুদ্ধ হয়, তা হলে দর্শকও তা গ্রহণ করে। আমি তো রাজি। দ্রৌপদী আমার কাছে স্বপ্নের চরিত্র।”
উদ্দেশ্য সৎ থাকলে দর্শক গ্রহণ করে, বলছেন আশিস চট্টোপাধ্যায়ও। মফস্বলের একটি নাট্যগোষ্ঠীর কর্ণধার তিনি। ওঁদের ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ নাটকের শেষ দৃশ্যে ক্ষমতার আগ্রাসনের নগ্ন রূপকে প্রকাশের তাগিদে এক অভিনেতাকে নগ্ন ভাবেই উপস্থাপন করা হয় মঞ্চে। “কলকাতা, জেলা সর্বত্র নাটকটা নিয়ে গিয়েছি, এখনও অভিনয় চলছে। দর্শক সাদরে গ্রহণ করেছেন।” এই নাটকের বয়সও কিন্তু ১২ বছর।
এক সময় মঞ্চে মেয়েদের অভিনয় ঘিরেই ছিল শত বাধা! সময় বদলায়, নতুন প্রজন্মকে ঘিরে তাই আশা রাখতে চান সোহাগ। পা বাড়াতে তৈরি সোহিনী। রেশমীর মনে স্বপ্ন। সুমন বলছেন, তেমন মুহূর্ত এলে ভেবে দেখব। কলকাতা প্রস্তুত তো?
|
সোহাগ সেন
এক বার করব ভেবেছিলাম।
হয়নি। নতুনরা নিশ্চয়ই পারবে।
|
কানহাইয়া লাল
নারীবাদের স্পিরিটটা বেশির
ভাগই ধরতে পারেন না।
|
সোহিনী সেনগুপ্ত
করা যায়। আমি রাজি। দ্রৌপদী
আমার কাছে স্বপ্নের চরিত্র। |
|