রাজ্য বলছে টাকা মিলছে না, পড়ে সাংসদদের ১৩৫ কোটি |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, উন্নয়নের জন্য মনমোহন সিংহ টাকা দিচ্ছেন না। কিন্তু এলাকা উন্নয়নের জন্য সাংসদদের যে টাকা দেওয়া হয় (এমপিল্যাড), তা রাজ্য সরকার কেন খরচ করতে পারছে না, সেই প্রশ্ন তুলল কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় কর্মসূচি রূপায়ণ মন্ত্রী সুবোধকান্ত সহায়ের দাবি, “তহবিল মঞ্জুর হওয়া সত্ত্বেও গত তিন বছরে পশ্চিমবঙ্গ এমপিল্যাডের ১৩৪ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা খরচ করতে পারেনি।”
কেন্দ্রের এই অভিযোগ উড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পাল্টা বক্তব্য, টাকা খরচ না হওয়ার পিছনে মূল কারণ, কেন্দ্রের ভ্রান্ত নীতি। সেই কারণে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, আরও অনেক রাজ্যই এমপিল্যাডের টাকা খরচ করে উঠতে পারেনি।
লোকসভার সচিবালয় থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গের ৪২ জন লোকসভা সদস্যের জন্য ২০০৯ সালের এপ্রিল থেকে ২০১২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত এলাকা উন্নয়ন তহবিল খাতে ৩৬০ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা মঞ্জুর হয়েছে। এর মধ্যে খরচ হয়েছে ১৯৪ কোটি ১৩ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা। ১৬ জন রাজ্যসভার সাংসদের এমপিল্যাডের টাকা ধরলে ওই তিন বছরে বরাদ্দ করা মোট অর্থের পরিমাণ ৪৬৮ কোটি ৭৩ লক্ষ টাকা। যার মধ্যে খরচ হয়েছে ৩৩৩ কোটি ৮৩ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ, গত তিন অর্থবর্ষে খরচ না হওয়া টাকার পরিমাণ ১৩৪ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা।
সুবোধকান্ত বলেন, “রাজ্য সরকারগুলিকে আমরা সমগ্র পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার পরামর্শ দিয়েছি। বলেছি, সব জেলার সঙ্গে কথা বলে এই খরচ না হওয়া অর্থের রহস্য ভেদ করতে হবে।”
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য মনে করেন, এই অভিযোগের সবটাই কেন্দ্রের একপেশে অপপ্রচার। তাঁর কথায়, “বিভিন্ন জেলায় এমপিল্যাডের টাকা যে খরচ হচ্ছে না, তার জন্য কেন্দ্রের ভ্রান্ত নীতি অনেকটাই দায়ী। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, অন্য রাজ্যও এই টাকা খরচ করতে পারছে না। কেন্দ্র টাকা খরচ করতে না পারার অভিযোগ তুলে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ ডেকে আনছে।”
|
সাংসদ এলাকা উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মসূচিগুলি বাস্তবায়িত হতে দেরি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে রাজ্য প্রশাসন সূত্রে বলা হচ্ছে, সাংসদরা যে সব সংস্থাকে দিয়ে কাজ করানোর সুপারিশ করেন তাদের দিয়ে কাজ করানোর ক্ষেত্রে আইনগত নানা অসুবিধা দেখা দেয়। ফলে সেই সব সংস্থাকে রাজ্য নিয়োগ করতে পারে না। তা ছাড়া, তহবিল বরাদ্দের ক্ষেত্রেও প্রশাসনিক গাফিলতি রয়েছে। বহু ক্ষেত্রে আমলারা এ ব্যাপারে গড়িমসি করেন।
অর্থ বরাদ্দ নিয়ে রাজ্যের অভিযোগ অবশ্য মানতে নারাজ কেন্দ্র। তাদের বক্তব্য, চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সচিবদের সঙ্গে ‘বাই-অ্যানুয়াল রিভিউ মিটিং’ করে অর্থ বণ্টন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করা হয়েছে। সুবোধকান্তের দাবি, চতুর্দশ লোকসভার মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত এমপিল্যাড খাতে যত টাকা প্রাপ্য হয়, পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ কেন্দ্রের ক্ষেত্রে তা বরাদ্দ করা হয়ে গিয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু কাঁথি, জলপাইগুড়ি, জয়নগর, মথুরাপুর এবং তমলুক।
মন্ত্রীর কথায়, “সাংসদ এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প রূপায়ণে দেরির জন্য যেখানেই মন্ত্রকের কাজে কোনও রাজ্য সরকার অভিযোগ করেছে, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। অফিসারদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।” তাঁর বক্তব্য, “প্রকল্পগুলি ৪৫ দিনের মধ্যে মঞ্জুর হবে বলা হলেও বাস্তবে তা হয় না। মিথিলেশ কুমার, যশবীর সিংহ, অশোক আর্গল, মহম্মদ আদিব, আর কে সিংহ পটেল এবং বিষ্ণুপদ রায় প্রমুখ সাংসদের একটি প্রতিনিধিদল এ বিষয়ে অভিযোগ করেছিল। মধ্যপ্রদেশের ভিন্দ জেলায় ২০০৯-’১০ থেকে ২০১১-’১২ পর্যন্ত ২২৭টি প্রকল্পে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শুরু হয়নি। এ কথা জেনে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছি। পশ্চিমবঙ্গের যদি কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, আমাকে জানালে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব।”
সাংসদ তহবিলের টাকা কী ভাবে খরচ হচ্ছে তা খতিয়ে দেখতে সম্প্রতি সমীক্ষা চালায় ‘ভোট ফর ইন্ডিয়া’ নামে সংসদ-স্বীকৃত একটি গবেষণা সংস্থা। লোকসভার স্পিকার মীরা কুমারকে তারা যে রিপোর্ট জমা দিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, গোটা দেশেই এমপিল্যাডের টাকা খরচের বেহাল দশা। তাদের হিসেব অনুযায়ী ২০১১-১২ সালে সাংসদেরা এলাকা উন্নয়ন খাতের ৬৯ শতাংশ টাকাই খরচ করতে পারেননি। এ রাজ্যের ব্যর্থতার হার সর্বভারতীয় হারের সমান। ত্রিপুরা বা কেরলের হাল পশ্চিমবঙ্গের থেকেও খারাপ। ত্রিপুরায় ২৪ শতাংশ অর্থ খরচ হয়েছে, কেরলে হয়েছে ২৩ শতাংশ। দলগত ভাবে তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ তহবিলের ৩৮ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে। সিপিএম ব্যয় করেছে ২৪ শতাংশ।
সাংসদ এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে প্রধানমন্ত্রীও বিরক্ত। তাঁর প্রস্তাব, কেন্দ্রীয় গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্প বা সেই ধরনের অন্য কেন্দ্রীয় প্রকল্পকে সাংসদ এলাকা উন্নয়ন তহবিলের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। লালকৃষ্ণ আডবাণী তো এই তহবিল তুলে দেওয়ারই পক্ষে। কিন্তু সুবোধকান্তের বক্তব্য, “রাজ্য সরকারগুলির সমস্যা যা-ই হোক, তা আমাদের জানাক। যৌথ ভাবে সমস্যার সমাধান হবে।” |