সবুজ ঘাসে ভরা উঁচু উঁচু চরের মাঠ। কোথাও দু’কিলোমিটার, কোথাও বা তারও বেশি দূরে গুটিকয় চালা ঘর। সবুজের মাঝে হালকা সবুজ রঙের সদ্য পাতা গজানো ছোট ছোট বাবলা আর ঝাউ গাছ। পরিবেশের সঙ্গে চরের নামও বড়ই মানানসই-‘নির্মল চর’। পদ্মা পাড়ের ঘন সবুজের মাঝে কাঁচা বাঁশের ৬টি খুঁটিতে নতুন পুরনো মিলিয়ে ৬টি টিনের ছাউনি। সেখানেই স্থান হয়েছে মা দুর্গার। কোনও বাজেট ছাড়াই। মহালয়া চলে গেলেও এখনও তুলির আঁচড় পড়েনি তার গায়ে। তবে রাস্তা, বিদ্যুৎ, স্কুলের মতও জরুরি পরিষেবা না থাকা গ্রামে পুজোর রং নেমেছে। ঘরে ঘরে শুরু হয়েছে নাড়ু, মুড়কি তৈরির কাজ। ঘরের পচে যাওয়া চালাটা বা বর্ষার জলে স্যাতসেতে দাওয়াটা নিকানোর কাজ চলছে জোরকদমে। বাজেট না থাকলে কী হবে ১০০ পরিবারের ছোট্টগ্রাম গিরি মণ্ডলের পাড়া এখন পুজোয় খুশির বাঁধ ভেঙেছে। |
নেই গ্রাম বললে ভুল হবে না। কারণ এখানে গুটিকয় মানুষ তাঁদের মাথা গোঁজার ছোট্ট চালা ছাড়া আর কিছুই নেই। কয়েক কিলোমিটার আল পথ মাড়িয়ে নৌকায় পদ্মা পেরিয়ে গ্রামের ছাত্র-ছাত্রীদের ভগবানগোলা ব্লক থেকে ডোমকলের রানিনগর-১ ব্লকের চর দৌলতপুর স্কুলে পড়তে আসতে হয়। পুজোর কটা দিন সেই পথ মাড়াতে হবে না এই আনন্দে মাতোয়ারা স্কুল পড়ুয়ারা। গ্রামের নাম গিরি মণ্ডলের পাড়া। গিরি মণ্ডলের ছেলে বছর বাহাত্তরের নারায়ণ চন্দ্র মণ্ডল বলেন, “একটা সময় আমাদের গ্রামের নাম ছিল ইলিশমারি। পদ্মার ভাঙনে ভেঙে ২২ বছর আগে নতুন গ্রাম গড়েছি। তবে পুজো ১৫০ বছরের পুরনো। সব হারালেও বছরের এই দিনকটা আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যায়নি। বাবার কাছে শুনেছি একটা সময় কাশিম বাজারের রাজা মণীন্দ্রচন্দ্রের মধ্যে ছিল এই এলাকা। রাজাবাবুদের আর্থিক সহয়তায় ধুমধাম করে পুজো হত তখন।”
জমিদার নেই। তার সাহায্যও বন্ধ। কিন্তু মায়ের পুজো তো আর বন্ধ করা যায় না। বললেন পবন মণ্ডল। তাঁর কথায়, “নিজেদের বাগানের বাঁশ, বাড়ির ছাউনি থেকে খুলে নেওয়া টিন। খরচ বলতে কেবল মালাকারের মজুরি, আর ঠাকুর মহাশয়ের দক্ষিণা। ঢাক ভাড়া করে ঢাকের খরচটাও কমিয়ে এনেছি।” এ তো গেল পুজোর বিষয়, ওই কটা দিন খাওয়া দাওয়া? চরের মাঠের মোটা চাল, কলাইয়ের ডাল এক সঙ্গে মিশিয়ে দিলেই হল। এছাড়াও রয়েছে নাড়ু, মুড়কি, চিড়ে। তবে পদ্মার টাটকা ইলিশ বাদ কেন মেনু থেকে? ওটা তো প্রায় হয়। এই কটা দিন না হয় অন্য কিছুর স্বাদ নিলাম। টিনের ছাউনির পাশে দাঁড়িয়ে বললেন শঙ্করি মণ্ডল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কাকিমাকে গ্রামের স্কুল পড়ুয়া শিলা নিয়তি মণ্ডল মনে করিয়ে দিলেন, কলাইয়ের জিলিপি, তেলে ভাজা আর গুড়ের ঝুরির কথা।
ভাড়ার গ্রাম বললেও ভুল হবে না গিরি মণ্ডলের পাড়াকে। কারণ এখানে প্রায় পরিবার চরের উঁচু জমি ভাড়া নিয়ে থাকেন গ্রামে। গ্রামের ধরণী মণ্ডলের কথায়, “খাস জমি থাকলেও তা নিচু এলাকা। ফলে বছরে হাজার টাকা বিঘা দরে জমি ভাড়া নিয়ে বাস করতে আমাদের। গিরিবাবুর দানে মায়ের মন্দিরের জায়গা হলেও সেটা নিচু। ফলে বন্যা হলে মায়ের স্থানও হয় ভাড়া জমিতে।” আখেরিগঞ্জ পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ফরওয়ার্ড ব্লকের সারথি মণ্ডল বলেন, “এখানে না এলে বোঝা যাবে না মানুষের কষ্ট। এই চর থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে গেলে তিন কিলোমিটার হাঁটতে হয়। আর চিকিৎসার প্রয়োজন হলে মাইল দশেক দূরে লালবাগ যেতে হয়।” তবে ‘নেই’ গ্রামের চারপাশ ঘিরে আছে কাশফুল, সবুজ মাঠ আর মাটিতে ঠেকে যাওয়া নীল আকাশ। নিন্দুকেরা যতই বলুক ‘নেই’ গ্রাম, এই আনন্দটুকুই বা কটা গ্রামে রয়েছে। |