আগেই এক বার সিউড়ির হাসপাতাল থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিল সে। কিন্তু যথেষ্ট সতর্কতা নেওয়া হয়নি। আর সেই সুযোগেই বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে পালাল রেণু সরকার হত্যাকাণ্ডে মূল অভিযুক্ত মঙ্গল সাহানি।
পেটে যন্ত্রণার কথা বলায় সোমবার রাত ৯টা নাগাদ একটি ভাড়াগাড়িতে মঙ্গলকে বর্ধমান মেডিক্যালে নিয়ে এসেছিলেন দুই কারারক্ষী। তাঁদের এক জন যখন কাগজপত্র তৈরি করাতে গিয়েছেন, সেই সময়ে গাড়ি থেকেই পালায় সে। রেণুদেবীর মেয়ে অদিতি সরকারের মতে, “ওকে যেন পালাতেই দেওয়া হল। ঠিকঠাক তদন্ত হলে রহস্য ভেদ হবে।” বর্ধমান কেন্দ্রীয় কারাগারের তরফে কেউ মন্তব্য করতে চাননি। তবে জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা বলেন, “কারা দফতরের তদন্তে দুই কারারক্ষীর গাফিলতির স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে। বরখাস্ত করা হতে পারে বলে
|
—নিজস্ব চিত্র |
শুনেছি।” চেষ্টা করেও আইজি (কারা) রণবীর কুমারের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
গত ১৩ জানুয়ারি রাতে শান্তিনিকেতনে বাগানপাড়ার বাড়িতে খুন হন মহাদেবী বিড়লা গার্লস স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা রেণু সরকার (৭৮)। বাড়ির কেয়ারটেকার উজ্জ্বল তপাদারের পাশাপাশি অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত মঙ্গল। প্রথমে বীরভূমের সিউড়ি সংশোধনাগারে রাখা হয়েছিল তাকে। একাধিক বার সিউড়ি সদর হাসপাতালে ভর্তিও হয় সে। কিন্তু সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করেও ধরা পড়ে যায়। এর পরে তাকে বোলপুর উপ-সংশোধনাগারে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ফের অসুস্থতার কথা জানানোয় গত ৫ অক্টোবর তাকে বর্ধমান মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয়। পরের দিন দুপুরে সেখান থেকে ছেড়ে দিলে তাকে বর্ধমান কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছিল। পুলিশ ও কারাগার সূত্রের খবর, সোমবার রাত ৮টা নাগাদ মঙ্গল ফের পেটে যন্ত্রণার কথা জানালে ডেপুটি জেলার মৃণালকান্তি মাহাতো তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। দুই কারারক্ষী দেবপ্রসাদ গড়াই ও প্রশান্তকুমার পাল ভাড়াগাড়িতে তাকে বর্ধমান মেডিক্যালে নিয়ে যান। পুলিশের জেরায় তাঁরা জানিয়েছেন, কারাগারের অ্যাম্বুল্যান্স খারাপ থাকায় ভাড়াগাড়ি নিতে হয়েছিল। প্রশান্তবাবু জরুরি বিভাগে কাগজপত্র তৈরি করাতে গিয়েছিলেন। গাড়িতে মঙ্গলের সঙ্গে ছিলেন চালক ও দেবপ্রসাদবাবু। হঠাৎই বিষে অসুস্থ এক রোগীকে নিয়ে কয়েক জন জরুরি বিভাগে এসে পৌঁছন। হইচই শুরু হয়ে যায়।
জরুরি বিভাগের কাছেই গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন চালক সাদরে আলম। তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন, আচমকা হট্টগোলে তাঁদের মনোযোগ সে দিকে সরে গিয়েছিল। তখনই তাঁর আর কারারক্ষীর মাঝখান দিয়ে মঙ্গল হাসপাতালের অক্সিজেন প্ল্যান্টের দিকে ছুট দেয়। তাঁরা ‘ধর-ধর’ করে কিছুটা ধাওয়া করলেও ভিড়ে মিশে যায় সে। আর তার নাগাল মেলেনি।
কিন্তু গোটা ঘটনা বেশ কিছু প্রশ্ন তুলছেন পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারাই।
এক, দীর্ঘদিন অ্যাম্বুল্যান্স খারাপ হয়ে থাকলে কারাগার কর্তৃপক্ষ তা জেলা প্রশাসনকে জানাননি কেন? |
জেলাশাসকের বক্তব্য, “অ্যাম্বুল্যান্স খারাপ থাকার কথা আমরা জানি না।” দুই, মঙ্গলের মতো দাগি অপরাধীকে রাতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগে পুলিশের সাহায্য চাওয়া হল না কেন? হাসপাতালের ডেপুটি সুপার তাপস ঘোষের কথায়, “সাধারণত তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনও অভিযুক্তকে আনা হলে পুলিশ আমাদের আগেভাগে জানায়। সোমবার রাতে কিছুই জানানো হয়নি।” বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা বলেন, “কোনও বন্দিকে যে রাতে হাসপাতালে আনা হচ্ছে, সে খবর পুলিশের কাছে ছিল না।” তিন, মঙ্গলের কোমরে দড়ি বাঁধা বা অন্য কোনও সাবধানতা নেওয়া হয়নি কেন? কেনই বা রক্ষী ও চালক গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে রইলেন? চার, মঙ্গল পালায় রাত সওয়া ৯টা নাগাদ। অথচ রাত সাড়ে ১১টার আগে বর্ধমান থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়নি নাগাদ। পাঁচ, হাসপাতালে পুলিশ ক্যাম্প রয়েছে। কেন দুই কারারক্ষী তাদের সাহায্য নিলেন না, সে প্রশ্নও এড়ানো যাচ্ছে না।
পুলিশের সন্দেহ, ঘটনার পিছনে কারারক্ষীদের একাংশের হাত থাকতে পারে। পুলিশ সুপার নিজে দুই কারারক্ষীকে দীর্ঘক্ষণ জেরাও করেন। তবে কারা কর্তৃপক্ষের তরফে কোনও ব্যাখ্যা মেলেনি। বারবার চেষ্টা করেও জেল সুপার মেইয়ামোদো গুঁইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। ডেপুটি জেল সুপার মন্তব্য এড়িয়ে গিয়েছেন। কারাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জেলাশাসক শরদ দ্বিবেদী দাবি করেন, অভিযুক্ত পালিয়ে যাওয়ার খবর তিনি মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত পাননি।
অদিতিদেবী বলেন, “এমন দাগি অপরাধীকে কি আরও সতর্কতার সঙ্গে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল না? আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন।” |