সকাল থেকে রাস্তার পাশে হাতে একটি লাল শার্ট ও কালো জিন্সের প্যান্ট হাতে বসেছিল বছর পনেরোর রিমিকা। পুজোয় পরার জন্য বাবার হাত ধরে বাজারে গিয়ে এই জামা-প্যান্ট কিনে এনেছিল তার ভাই কুন্তল। পুজোয় এ সব পরে ঠাকুর দেখা অবশ্য তার আর হবে না। সোমবার সকালেই ভাগরথী থেকে ডুবুরিরা তুলে এনেছে তার দেহ। উদ্ধার হয়েছে আরও দুই স্কুলপড়ুয়ার দেহ। কাঁদতে কাঁদতে রিমিকা বলে, “ভাইকে তো এই রাস্তা দিয়েই নিয়ে যাবে। জামা-প্যান্টগুলো ওকে দেব বলে বসে আছি।” |
রবিবার পূর্বস্থলীর পাটুলিতে ভাগীরথীতে স্নান করতে গিয়ে তলিয়ে গিয়েছিল চার কিশোর-কিশোরী। পুলিশ জানায়, এ দিন যে তিন জনের দেহ মিলেছে তাদের নাম প্রিয়া কর্মকার (১০), সাথী দাস (১৪) ও কুন্তল সাহা (১২)। পুষ্পিতা দে নামে নবম শ্রেণির এক ছাত্রী এখনও নিখোঁজ। মহালয়ার সকালে এমন ঘটনায় শোকের ছায়া নেমে আসে পাটুলির নারায়ণপুর গ্রামে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, নদিয়ার প্রাচীন মায়াপুর থেকে মেয়ে প্রিয়া ও প্রতিবেশীর মেয়ে সাথীকে সঙ্গে নিয়ে নারায়ণপুর গ্রামে বাপের বাড়িতে এসেছিলেন আরতি কর্মকার। সেখান থেকে ওই এলাকাতেই ভ্রাতৃবধূ কোয়েল দত্তের বাপের বাড়িতে যান তাঁরা। রবিবার বাড়ি থেকে সাত জনের একটি দল ভাগীরথীতে স্নান করতে যায়। কোয়েল ও চার কিশোর-কিশোরী জলে নামেন। হঠাৎই তাঁদের তলিয়ে যেতে দেখেন আশপাশের বাসিন্দারা। বাসিন্দাদের তৎপরতায় কোয়েল বেঁচে যান। কিন্তু চার স্কুল-পড়ুয়া তলিয়ে যায়। রবিবার রাত পর্যন্ত ডুবুরি নামিয়ে তল্লাশি চালিয়েও তাদের সন্ধান মেলেনি।
সোমবার কাটোয়ার অগ্রদ্বীপ থেকে ছ’জন ডুবুরি আনা হয়। তাঁরাই তল্লাশি চালিয়ে একে একে সাথী, প্রিয়া ও কুন্তলের দেহ জল থেকে তুলে আনেন। তবে বিকেল পর্যন্ত পুষ্পিতার কোনও খোঁজ মেলেনি। উদ্ধারকারী দলের নেতা ফুলচাঁদ দে বলেন, “যে এলাকায় চার জন তলিয়ে গিয়েছিল সেখানে আজও চোরা স্রোত রয়েছে। ভাগীরথীর পাড় বাঁধানোর খাঁচায় আটকে থাকা অবস্থায় তিনটি দেহ মিলেছে।” সোমবার সকাল থেকে ভকতপাড়া ঘাটে ভিড় জমান কয়েক হাজার মানুষ। তিন জনের দেহ তোলার পরে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। |
গ্রামের যে সরু রাস্তা ভাগীরথীর ঘাটে গিয়ে পড়েছে তারই এক পাশে বাড়ি রঞ্জিত দে-র। তাঁরই বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন আরতীদেবীরা। রঞ্জিতবাবুর বড় মেয়ে কোয়েল ঘাটের আশপাশের লোকজনের তৎপরতায় প্রাণে বাঁচলেও ছোট মেয়ে পুষ্পিতা তলিয়ে গিয়েছে। সোমবারও তার কোনও খোঁজ মেলেনি। বাড়ির পাশে বড় দুর্গা মণ্ডপের সামনে কাকভোর থেকে বসেছিলেন রঞ্জিতবাবু ও তাঁর আত্মীয়েরা। সকাল থেকেই বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন রঞ্জিতবাবুর স্ত্রী পার্বতীদেবী। মায়ের পাশে বসে অঝোরে কাঁদছিলেন কোয়েলও। তিনি বলেন, “আচমকা পা হড়কে গেল। আমি তলিয়ে শুরু করলাম। তা দেখে ভাই-বোনেরা এগিয়ে যেতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনল। আমি ফিরলাম। কিন্তু ওরা ফিরল না।” গত কয়েক দিনে রঙের প্রলেপ পড়েছে মন্দিরে। প্রতিবেশীরা জানালেন, পালপাড়ায় ঠাকুর গড়া হচ্ছে। ঢাক, মাইক, আলো সব কিছুর বন্দোবস্তই হয়ে গিয়েছে। মহালয়ার পর থেকেই গ্রামে আত্মীয়-কুটুম্বদের আনাগোনা শুরু হত। কিন্তু ইতিমধ্যে এমন দুর্ঘটনায় সব কিছুই থমকে গিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা বাসিন্দা হৃষিকেশ সাহার কথায়, “রঞ্জিতের পরিবারের সবাই পুজোয় অনেক কাজ করত। তাদের বিপদে গোটা গ্রাম শোকাহত।” আর এক বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “এত বড় দুর্ঘটনার পরে পুজো নিয়ে আমাদের আর কোনও উৎসাহ নেই।”
|
সোমবার পূর্বস্থলীর পাটুলিতে তোলা নিজস্ব চিত্র। |