কর কর তিন কর।
দিল্লির কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা অতি ক্ষীণ। আইনি বাঁধনে দেদার ঋণ নেওয়াও অসম্ভব। এই অবস্থায় ভূতের রাজার কাছ থেকে তিন বর পেলে হয়তো বর্তে যেত রাজ্য প্রশাসন। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না বলেই তিন করের উপরে ভরসা করতে হচ্ছে তাদের। তা-ও করের হার বাড়াবেন না মুখ্যমন্ত্রী। তাই বেড়ে চলা খরচ সামলাতে তুলনামূলক ভাবে নজরে না থাকা তিনটি ক্ষেত্রকে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। যেখানে করের আওতা এবং আদায় বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়াতে চাইছে অর্থ দফতর।
ক্ষেত্র তিনটি হল: এক, বেসরকারি ক্ষেত্রে অতি সাধারণ চাকুরেদের (যেমন, দোকান কর্মচারী, কারখানা কর্মী প্রভৃতি) থেকে বৃত্তি কর আদায়। দুই, ছোট-বড় সমস্ত ধরনের রেস্তোরাঁ থেকে কর আদায় করা। এবং তিন বিভিন্ন আবাসন, শপিং কমপ্লেক্স, মলে জেনারেটর চালালে তার উপর বিদ্যুৎ শুল্ক চাপানো। এই তিনটি ক্ষেত্র থেকে ঠিক কতটা রাজস্ব আদায় সম্ভব, তার নির্দিষ্ট হিসেব এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। বর্তমানে এই তিনটি ক্ষেত্রে কর বাবদ রাজ্য সরকারের ১২০০ কোটি টাকার বেশি আয় হয় না। নতুন ব্যবস্থা চালু হলে কর আদায়ের পরিমাণ বেড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা হবে বলেই আশা অর্থ দফতরের কর্তাদের।
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মমতা বলে আসছেন, তাঁদের ঘাড়ে যে দু’লক্ষ কোটি টাকার ঋণের বোঝা চাপিয়ে গিয়েছে বামফ্রন্ট সরকার, তার সুদ-আসল মেটাতে আয়ের সবটা চলে যায়। তিনি বারবার কেন্দ্রের কাছে দরবার করেছেন যাতে, সুদ ও আসল শোধের উপরে তিন বছরের স্থগিতাদেশ জারি করে তারা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কোনও একটি রাজ্যের ক্ষেত্রে এমন স্থগিতাদেশ জারি করা যে সম্ভব নয়, কেন্দ্র তা জানিয়েছিল। বিচ্ছেদের পরে বিশেষ আর্থিক প্যাকেজ পাওয়া তো এখন আরও দুরাশা। বাজার থেকে বছরে ২০ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা ধার করতে পারে রাজ্য। প্রথম সাত মাসে তার মধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকা ধার নেওয়া হয়ে গিয়েছে। এর উপরে রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা বজায় রাখতে মমতা করের হার বাড়াতে নারাজ।
তা হলে রাজ্যের রোজগার বাড়বে কী করে? |
গত বাজেটে নতুন বলতে একমাত্র প্রবেশ কর ফের চালু করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। অন্য সব খাতে রাজস্ব আদায় বাড়াতে তাঁর দাওয়াই, যত বেশি সম্ভব লোককে করের আওতায় নিয়ে আসা এবং কর দেওয়ার ব্যবস্থার সরলীকরণ। সেই লক্ষ্যেই চালু হয়েছে ই-গভর্ন্যান্স। তার পর দেশি মদ এবং জমি-বাড়ির রেজিস্ট্রেশন থেকে কর আদায় বাড়াতে পরিকাঠামো তৈরি ও অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। উৎসবের মরসুমে গভীর রাত পর্যন্ত পানশালা খুলে রেখেও বাড়তি রোজগারের চেষ্টা চলছে। এই তিন করের এক্তিয়ার বাড়ানোও একই পরিকল্পনার অঙ্গ বলে জানাচ্ছেন অর্থ দফতরের কর্তারা।
অর্থ দফতর সূত্রের খবর, গত সপ্তাহ থেকেই রাজ্যের ভ্যাট ডিলারদের (যাঁরা ভ্যাট দিয়ে থাকেন) কাছে নোটিস পাঠানো শুরু হয়েছে। তাতে প্রত্যেক ডিলারকে তাঁদের কর্মী সংখ্যা জানাতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে কর্মচারীদের কাছ থেকে বৃত্তি কর কেটে রিটার্ন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যার অর্থ, এ বার থেকে দোকান কর্মীদেরও বৃত্তি কর দিতে হবে।
রাজ্যে মোট ১২৬টি পুর এলাকা রয়েছে। তাদের কাছে নথিভুক্ত রেস্তোরাঁর সংখ্যা জানতে চেয়েছে অর্থ দফতর। পুরসভার কাছ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করে রেস্তোরাঁগুলি। কর চাপাতে গেলে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে নেওয়া জরুরি। সেই পথেই প্রথম পা ফেলেছে অর্থ দফতর। পাশাপাশি খবরের কাগজে বিজ্ঞপ্তি জারি করেও রেস্তোরাঁ মালিকদের বলা হয়েছে অর্থ দফতরে নাম নথিভুক্ত করতে।
একই ভাবে বিদ্যুৎ শুল্ক আদায়ের ক্ষেত্রেও বড় জেনারেটরের সংখ্যা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। অর্থ দফতর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আড়াই কিলোভোল্ট ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে শুল্ক দিতে হবে। দফতরের কর্তাদের প্রাথমিক ধারণা, রাজ্যে অন্তত ১০ হাজার এমন জেনারেটরের হদিস মিলবে। ফলে মোটা টাকা রোজগার হওয়া সম্ভব।
কেন সরকার রাজস্ব বাড়াতে এই তিনটি ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করল? অর্থ দফতরের এক কর্তা জানান, এই তিনটি ক্ষেত্র থেকে যা কর আদায় হওয়া উচিত, তার চেয়ে অনেক কম আদায় হয়। যেমন, সংগঠিত ক্ষেত্রে প্রত্যেক রোজগেরেরই বৃত্তি কর দেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে মাত্র ৫০ হাজার নিয়োগকর্তা তাঁদের কর্মীদের কাছ থেকে বৃত্তি কর কেটে কোষাগারে জমা দিচ্ছেন। অথচ এই পঞ্চাশ হাজারের বাইরেও রাজ্যে নথিভুক্ত ভ্যাট ডিলারের সংখ্যা এক লক্ষের বেশি। তা ছাড়া আরও লক্ষাধিক রেজিস্টার্ড সংস্থা রয়েছে। অর্থ দফতরের ওই কর্তা জানান, বৃত্তি কর আদায় বাড়াতে প্রথম ধাপে ভ্যাট ডিলারদেরই নোটিস পাঠানো হচ্ছে। পরের ধাপে রেজিস্টার্ড সংস্থাগুলির কাছে কর্মীদের হিসেব চেয়ে পাঠানো হবে। অর্থ দফতরের বক্তব্য, বৃত্তি করের পরিমাণ সামান্য। মাসে ১১০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। ফলে তা দিতে কারও অনীহা থাকার কথা নয়। শুধু আদায়ের ব্যবস্থা করতে পারলেই হল।
এর ফলে রাজস্ব কতটা বাড়বে? কর্তাদের দাবি, গত বছরে ৪২৩ কোটি টাকা বৃত্তি কর আদায় হয়েছিল। চলতি আর্থিক বছরে তা বাড়িয়ে ৪৬৫ কোটি টাকা করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। যে দুই লক্ষাধিক নিয়োগকর্তা বৃত্তি কর জমা দেন না, তাঁদের এই করের আওতায় আনা গেলে হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহও অসম্ভব নয়। তবে এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ বৃত্তি কর আদায় হবে বলেই মনে করছেন অর্থ দফতরের কর্তারা।
অর্থ দফতরের পরের লক্ষ্য রেস্তোরাঁ থেকে কর আদায় বাড়ানো। অর্থ দফতর সূত্রে মতে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রেস্তোরাঁ মালিকরা হয় অজ্ঞতার জন্য কর দেন না, অথবা ফ্লোর এরিয়া কম দেখিয়ে কর ফাঁকি দেন। রাজ্যের সব ক’টি পুর এলাকা থেকে এই খাতে অন্তত ২০০ কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে ধারণা কর্তাদের। এখন এই খাতে আদায় হয় মাত্র সাড়ে ১৬ কোটি!
বিদ্যুতের শুল্ক সম্পর্কে অর্থ দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, এখন মাত্র পাঁচটি বড় উৎপাদনকারী সংস্থা এই শুল্ক দিয়ে থাকে। কিন্তু বড় জেনারেটর থেকেও কর আদায়ের সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে আবাসন, শপিং মল, কর্পোরেট অফিসে যে ভাবে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন জেনারেটর বসানো হচ্ছে, তাতে কর বসালে মোটা টাকা রোজগার হবে। গত বছর এই খাতে ৬২৮ কোটি টাকা আদায় হয়েছিল। এ বার সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আদায় সরকার কী ভাবে কর আদায়ে নামছে? অর্থ দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, যে তিনটি ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করা হয়েছে সেখান থেকে কর আদায়ের জন্য স্বেচ্ছা-ঘোষণার উপরই সব চেয়ে বেশি জোর দেওয়া হবে। দফতর তিনটি বিষয়ে একটি ‘কমন পোর্টাল’ করার কাজে হাত দিয়েছে। বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে নিজেদের কর দেওয়ার ঘোষণা করতে বলা হবে। পাশাপাশি কর দেয় না এমন সংস্থা, মালিক, নিয়োগকর্তার তথ্যপঞ্জি তৈরি রাখা হচ্ছে। প্রয়োজনে অভিযানে নামতেও পিছ পা হবে না অর্থ দফতর। ওই কর্তাদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী যে হেতু করের হার বাড়াতে দিচ্ছেন না, তাই তার আওতা বাড়ানোর দিকেই নজর দেওয়া হয়েছে। তাতে কর না বাড়িয়েও রাজস্ব আদায় বাড়ানো সম্ভব হবে। |