রেস্তোরাঁয় অন্যের পাতের খাবার আর রাস্তায় অন্য মহিলার বর (অন্য পুরুষের বউ তো বটেই) বেশি মনে ধরে না? খাবারের কথাটা নিশ্চয়ই প্রকাশ্যে স্বীকার করবেন।
অথচ, নিজের বউয়ের চেয়ে অন্যের বউকে বেশি মনে ধরলে বিয়েটাই নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে। সেই পরিস্থিতি যাতে তৈরিই না হয়, তার জন্য ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস এঞ্জেলেস-এর প্রফেসর এমেরিটাস লয়েড শ্যাপলির শরণ নিতে পারেন। ১৯৬২ সালে শ্যাপলি এবং ডেভিড গেল বিয়ে ‘টিকিয়ে রাখার পন্থা’ আবিষ্কার করেন। গেল ২০০৮ সালে মারা গিয়েছেন। শ্যাপলি তাঁদের কাজের জন্য ২০১২ সালের অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার পেলেন। তাঁর সঙ্গে পুরস্কার ভাগ করে নিয়েছেন হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের অ্যালভিন রথ। গেল-শ্যাপলির দেওয়া ‘স্টেবল ম্যারেজ প্রবলেম’-এর সমাধানসূত্র কাজে লাগিয়ে তিনি বেশ কয়েকটা সমস্যার সমাধান করেছেন, যার মধ্যে ডাক্তারির ছাত্রদের ইন্টার্নশিপের হাসপাতাল বাছাই যেমন আছে, তেমনই আছে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য জোড়া খুঁজে বার করার সমস্যা।
নোবেল কমিটি জানিয়েছে, ভেঙে যাবে না, এমন স্থিতিশীল জুড়িতে সম্পদ বণ্টনের পদ্ধতি নির্ধারণ করার জন্য, এবং কী ভাবে সেই পদ্ধতিকে কাজে লাগানো যায়, তা নির্দেশ করতে পারার জন্যই অ্যালভিন রথ এবং লয়েড শ্যাপলি-কে পুরস্কার দেওয়া হল। তাঁরা অবশ্য এক সঙ্গে কাজ করেননি। শ্যাপলির বয়স এখন ৮৯। যে কাজের জন্য তিনি নোবেল পেলেন, সেটি ১৯৬২ সালের। রথ তাঁর নোবেলেজয়ী গবেষণাটি শেষ করেছিলেন ১৯৯৯ সালে।
বিয়ে কেন ভাঙে? অর্থনীতিবিদরা বলবেন, যদি নিজের বরের চেয়ে অন্যের বরকে বেশি ভাল লাগে (অথবা নিজের বউয়ের চেয়ে অন্যের বউকে) এবং যদি সেই বেশি পছন্দের মানুষটিকে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তা হলেই বিয়ে ভাঙবে। এই সম্ভাবনাটিকে ঘুচিয়ে দিতে পারলেই বিয়ে টিকতে বাধ্য। |
সেটা কী ভাবে সম্ভব, দেখিয়েছিলেন গেল আর শ্যাপলি। ধরা যাক, দশ জোড়া বিবাহযোগ্য পুরুষ এবং মহিলা আছেন (পুরুষ এবং মহিলার সংখ্যা সমান হতেই হবে)। এই কুড়ি জনকে একটা ঘরে বসানো হল। বলা হল, এক এক করে প্রত্যেক পুরুষ তাঁর পছন্দের মহিলাটিকে বিয়ের প্রস্তাব দেবেন। মহিলা সম্মত হলে বলবেন, ‘হয়তো’; অসম্মত হলে বলবেন, ‘না’। যে পুরুষের পছন্দের মহিলা তাঁকে ‘হয়তো’ বলবেন, সেই পুরুষটি ‘সাময়িক ভাবে বাগদত্ত’, মহিলাও ‘সাময়িক ভাবে বাগদত্তা’। প্রথম দফায় যে পুরুষদের ভাগ্য মন্দ, তাঁরা দ্বিতীয় দফায় ফের বিবাহের প্রস্তাব দেবেন। মজার ব্যাপার, তাঁরা শুধুমাত্র প্রথম বার যিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাঁকে ছাড়া বাকি নয় জন মহিলার মধ্যে যাঁকে মন চায় তাঁকেই প্রস্তাব দিতে পারেন তিনি ‘সাময়িক ভাবে বাগদত্তা’ কি না, ভাবার দরকার নেই। বাগদত্তা মহিলাও ইচ্ছা করলে প্রথম দফায় পছন্দ করা পুরুষটিকে বাতিল করে দ্বিতীয় প্রস্তাবকারীকে ‘হয়তো’ বলতে পারেন। এই দফাতেও যে পুরুষদের ভাগ্য মন্দ, তাঁদের জন্য তৃতীয় দফা রয়েছে। তাঁরাও নির্দ্বিধায় অন্যের বাগদত্তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারেন। এই ভাবে চললে, দশ জোড়া পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে, সবচেয়ে বেশি দশ দফায় সবার পছন্দসই জোড়া তৈরি হবে।
এই জুড়িগুলো টেকসই হবে। বিয়ে তো তখনই ভাঙবে, যদি জানা থাকে যে বিয়ে ভেঙে বেশি পছন্দের মানুষটিকে বিয়ে করা সম্ভব হবে। এই ক্ষেত্রে যাঁর সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে, তাঁর চেয়ে যাঁদের বেশি পছন্দ হয়, তাঁরা ইতিমধ্যেই বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। কাজেই, শুরু থেকেই জানা আছে যে তাঁদের পাওয়া যাবে না। যাঁদের পাওয়া যাবে, তাঁরা বিয়ে করা বর বা বউয়ের তুলনায় কম পছন্দের। কাজেই, বিয়ে ভাঙার আর সম্ভাবনা থাকল না। অ্যালভিন রথ এই সূত্রকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডাক্তারি ছাত্রদের ইন্টার্নশিপ বা শিক্ষানবিশির কলেজ বাছাই নিয়ে অশান্তি দীর্ঘ দিনের। কোন ছাত্র কোন হাসপাতালে শিক্ষানবিশি করতে যাবেন, তা স্থির করার জন্য ১৯৫২ সালে ন্যাশনাল রেসিডেন্ট ম্যাচিং প্রোগ্রাম নামে একটি বেসরকারি সংস্থা তৈরি হয়। কিন্তু এখানেও বিয়ের মতো সমস্যা ছাত্রের হাসপাতাল পছন্দ হয় না, আবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষরও ছাত্র বাছাইয়ের পর অন্য হাসপাতালে চলে যাওয়া ছাত্রকেই বেশি ভাল লাগতে থাকে। রথকে এই সমস্যাটি দীর্ঘ দিন আকর্ষণ করেছিল। ১৯৮৪ সালে তিনি একটি গবেষণাপত্রে প্রমাণ করেন, গেল-শ্যাপলির মডেলের ওপর নির্ভরশীল এই ব্যবস্থাটি অবিবাহিত ছাত্রদের জন্য একদম ঠিকঠাক, কিন্তু ছাত্রের বিয়ে হয়ে গেলেই আর ব্যবস্থাটি কাজ করে না। ১৯৯৯ সালে তিনি আরও এক ধাপ এগোলেন। এই ব্যবস্থাটি যাতে বিবাহিত ছাত্রদেরও তাদের সম্ভাব্য বিকল্প হাসপাতালগুলির সেরাটিতে পৌঁছে দিতে পারে, সেই মডেল তৈরি করলেন। নিউ ইয়র্ক এবং বস্টনের পাবলিক স্কুলে ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রেও সেরা ব্যবস্থাটি কী হবে, নির্ণয় করে দিয়েছেন রথ।
তবে, তাঁর যে কাজটি মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে পারে, তা হল অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে জোড় বাছাই সংক্রান্ত গবেষণা। দেখা যায়, কিডনির অসুখে আক্রান্ত স্বামীকে কিডনি দিতে রাজি তাঁর স্ত্রী, কিন্তু স্ত্রীর কিডনি স্বামীর শরীরে প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়। এ দিকে, অঙ্গ কেনা-বেচা অনেক দেশের আইনেই নিষিদ্ধ। ফলে, এই জাতীয় ক্ষেত্রে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না। রথ ও তাঁর দুই সহযোগী তেফুন সোনমেজ ও উটকু আনভার এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছেন, যাতে এই রকম দু’জোড়া রোগী-অঙ্গদাতা থাকলেই তাঁদের মধ্যে কিডনি বিনিময় সম্ভব। অর্থনীতিতে নোবেল না পেলে, কে বলতে পারে, রথ হয়তো কখনও চিকিৎসাশাস্ত্রেই নোবেল পেতে পারতেন। |