|
|
|
|
প্রাত্যহিকীর বাইরে দেবী সাজাতে শোলা জোগাড়
আনন্দ মণ্ডল • তমলুক |
চাষবাস, দিনমজুরি বা ফেরিওয়ালার কাজ করেই কাটে বছরের ন’মাস। তবে বাকি তিন মাস একটু অন্যরকম। শরতের ঢাক বাজলেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শোলা জোগাড় করতে বেরিয়ে পড়েন ওঁরা। একটু বেশি রোজগারের আশা তো বটেই, তবে দেবীকে সাজানোর তাগিদও কিছু কম নয় ওঁদের।
পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাটের ভোগপুর গ্রামের মুসলিম পাড়ার শেখ রসিদ, শেখ জাবেদ, নূর আমিনদের ওই তিন মাসের দিন গুজরান হয় এভাবেই। ভাদ্র, আশ্বিন, আর কার্তিক এই তিন মাস পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং, বালিচক ও ওড়িশার বিভিন্ন এলাকায় পাড়ি দেন এঁরা। কাজ শোলা জোগাড় করে তা শুকনো করে উলুবেড়িয়া, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর ও কলকাতার উল্টোডাঙ্গায় মালাকার পাড়ায় পৌঁছে দেওয়া। প্রায় ৪০ বছর ধরে শোলা সংগ্রহের পাশাপাশি জমি লিজ নিয়ে শোলা চাষও করেন এই গ্রামের বেশ কিছু পরিবার।
ভোগপুর রেলস্টেশন থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের মুসলিম পাড়ার বাসিন্দা শেখ রসিদের বাড়ির উঠোনে পড়ে রয়েছে শোলার বান্ডিল। ওড়িশা থেকে শোলা জোগাড় করে ট্রেনে চাপিয়ে এনেছেন বাড়িতে। এখন চলছে রোদে শুকোনোর পালা। এরপরে তা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে নির্দিষ্ট মাপের বান্ডিলে বেঁধে পৌঁছে দিতে হবে মালাকারদের কাছে। বছর চল্লিশের শেখ রসিদ এই পেশায় যুক্ত গত ২০ বছর ধরে। তাঁর বাবা শেখ জলিলও এই কাজই করতেন। ফি বছর প্রায় ১৫০-২০০ বান্ডিল শোলা সংগ্রহ ও বিক্রি করেন তিনি। বছরের বাকি সময়টা ফেরিওয়ালার কাজ করা রসিদ জানান, “ভাদ্র, আশ্বিন, কার্ত্তিক এই তিন মাসই শোলার কাজ করি। ওড়িশা, সবং, বালিচক, দেহাটি এসব এলাকায় মাঠে গিয়ে শোলা কাটতে হয়। জলাজমিতে শোলাগাছের ঝোপে বিষধর সাপ ও বিভিন্ন ধরনের জোঁক থাকায় রীতিমতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়।” তিনিই জানান, শোলা কাটতে গিয়ে বছর পাঁচেক আগে পাড়ারই শেখ আজিজ ওড়িশার ছত্রপুরে জলে ডুবে মারা যায়। কিন্তু তাও দুটো বেশি পয়সার তাগিদে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও এই কাজ করেন তাঁরা। রসিদই জানান, এই সময় শোলার চাবিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। মূলত দু’ধরনের শোলা হয়। ভেতুয়া ও কাঠ শোলা। তবে ঠাকুরের গয়না তৈরির জন্য নরম ও হালকা ভেতুয়া শোলা ব্যবহার করা হয়।
পুজার আগে বিভিন্ন জায়গা থেকে কাঁচা শোলা কেটে বাড়িতে এনে প্রায় ৫ দিন ধরে শুকনো ও পরিষ্কার করার পর বান্ডিল করে মালাকারদের কাছে পৌঁছে দেন তাঁরা। আবার অনেক সময় মালাকাররা এসেও শোলা কিনে নিয়ে যান। ঠাকুরের চুড়া, গয়না, ডাকের সাজ ও চাঁদমালা তৈরি ছাড়াও সারা বছরের বিয়ের টোপর তৈরির শোলাও মালাকাররা এই সময়ই সংগ্রহ করে নেন। ওই পাড়ারই বাসিন্দা শেখ আব্দুল মজিদ ও শেখ কিসমত। দুই ভাই মিলে শোলা জোগাড় ও বিক্রির কাজ করছেন প্রায় ২৫ বছর। তবে বছরের অন্য সময় দিনমজুরির কাজ করেন তাঁরা। দু’জনেই জানান, বর্ষার সময় ফাঁকা জলাজমিতে শোলা চাষের জন্য চাষিদের কাছ থেকে জমি লিজ নিতে হয়। এ জন্য অনেক সময় অগ্রিম টাকাও দিতে হয়। কিন্তু ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ না মেলায় টাকা জোগাড় করতে হিমসিম খেতে হয়। স্থানীয় শেখ জবেদ, শেখ রহিম ও নুর আমিনরাও দীর্ঘদিন ধরে এই ঝুঁকির কাজ করছেন। কাজে সাহায্য করেন পরিবারের অন্যরাও। তাই প্রতিবছর পূজার আগে মা’কে সাজাতে ব্যস্ততা বাড়ে ভোগপুরের রসিদ, রহিম, নূর আমিনদের পরিবারে।
মায়ের রূপে খোলতাই আনতে বছরের পর বছর খুশি মনেই শোলার জোগাড় দেন মুসলিমপাড়ার এই বাসিন্দারা। |
|
|
|
|
|