বড় জনসংখ্যাকে এখন আর অভিশাপ হিসাবে দেখা হয় না, যদি দেশের নীচের তলার মানুষের আর্থিক সঙ্গতি এবং ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব হয়।
ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে বাড়ে পণ্যের চাহিদা। ফলে বাড়ে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান। ভারতে আর্থিক বৃদ্ধি বিগত কয়েক বছরে বেশ ভালই হয়েছে, যদিও তার বণ্টন সুষম হয়নি। বেশির ভাগটাই থেকে গিয়েছে উপরতলায়। তবে জাতীয় আয়ের ছোট ভগ্নাংশ নিচুতলায় এলেও সাধারণ মানুষের যে ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
ভারতের মধ্যবিত্ত সমাজের আকার বেশ বড়। এই সমাজের দিকে তাকিয়েই ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ছকে অসংখ্য দেশি-বিদেশি কোম্পানি। দেশি-বিদেশি খুচরো পণ্য বিক্রেতাদের মূল লক্ষ্য এঁরাই। ইউরোপ আমেরিকার অর্থনৈতিক দুর্দশার দিনে পণ্য বিক্রির এত বড় বাজারকে হাতছাড়া করতে কেউই চাইছে না। এই কারণেই ভারতে খুচরো ব্যবসায় পা রাখার জন্য বিদেশিদের এত তাগিদ।
আরও একটি কারণে ব্যবসায়ীদের কাছে ভারতের আকর্ষণ অনেক দেশের তুলনায় বেশি। ভারতের তরুণ প্রজন্ম, যাঁদের সঞ্চয়ের তুলনায় খরচে আগ্রহ বেশি, তাঁদের আকার বিশাল। দেশের জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশের বয়স ৩৫ বছরের মধ্যে। জনসংখ্যার অর্ধেকের বয়স ২৫ বছরের বেশি নয়। অনুমান, ২০২০ সালের মধ্যে ভারতীয়দের গড় বয়স কমে হবে মাত্র ২৯ বছর, যেখানে চিন এবং জাপানের জনসংখ্যার গড় বয়স যথাক্রমে ৩৭ এবং ৪৮ বছর। দেশের তরুণ প্রজন্ম ভোগবাদে বেশি গুরুত্ব দেওয়ায় গাড়ি, মোটরবাইক, ইলেকট্রনিক পণ্য-সহ দেশি বিদেশি অসংখ্য পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। দ্রুত বেড়ে উঠছে শপিং মল্ সংস্কৃতি। সন্দেহ নেই, এতে বেড়েছে পণ্যের চাহিদা, পাশাপাশি কমর্সংস্থানও।
তরুণ প্রজন্ম ভোগবাদে মেতে ওঠায় সঞ্চয়ের হার কমার আশঙ্কা অবশ্য থাকছে। দেশের অগ্রগতিতে যেমন খরচের, তেমন সঞ্চয়েরও বড় ভূমিকা থাকে। সঞ্চয় কমলে শিল্পে লগ্নি কমার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ ভোগ ও সঞ্চয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। |
দীর্ঘ মেয়াদি সঞ্চয়ের সারণি |
মাসিক সঞ্চয়
(টাকা) |
মেয়াদ
(বছর/মাস) |
মোট জমা
(টাকা) |
সুদের হার
(শতাংশ) |
মেয়াদ শেষে
প্রাপ্ত (টাকা) |
৫০০ |
৩৬ বছর (৪৩২ মাস) |
২,১৬,০০০ |
৮.৫ |
১৩,১৮,০০০ |
১০০০ |
৩৬ বছর (৪৩২ মাস) |
৪,৩২,০০০ |
৮.৫ |
২৬,৩৬,০০০ |
৩৮০০ |
৩৬ বছর (৪৩২ মাস) |
১৬,৪১,৬০০ |
৮.৫ |
১ কোটি ১৯ হাজার |
|
শুধু দেশ নয়, ব্যক্তিবিশেষের দৃষ্টিকোণ থেকেও ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য নিয়মিত সঞ্চয় অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে যাঁদের সামাজিক সুরক্ষা কার্যত নেই। অসংগঠিত ক্ষেত্রের অসংখ্য কর্মী, স্বনিযুক্ত, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, অটো এবং গাড়ি চালক, চাষি, ছোট কারখানার শ্রমিক, নানা ধরনের মিস্ত্রি, যাঁদের সামাজিক সুরক্ষা নেই অথচ কাজের ঝুঁকি আছে তাঁদের সীমিত সঞ্চয় এবং ন্যূনতম বিমা অত্যাবশ্যক। নিয়মিত যদি অতি অল্পও সঞ্চয় করা যায় ব্যাঙ্কের রেকারিং ডিপোজিটে, তবে তা দীর্ঘ মেয়াদে চক্রবৃদ্ধি সুদের শক্তিতে একটি বড় তহবিলে পরিণত হতে পারে।
এ ধরনের রেকারিং ডিপোজিট অ্যাকাউন্টে দীর্ঘ মেয়াদে টাকা জমানো যায়। তবে সে ক্ষেত্রে একটি মেয়াদ শেষ হলে জমা টাকা মেয়াদি জমায় গচ্ছিত করে আর একটি রেকারিং অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। এর একটি কাল্পনিক উদাহরণ দেওয়া হল সঙ্গের সারণিতে। এই উদাহরণে মানুষের গড় কর্মজীবন ধরা হয়েছে ৩৬ বছর (২৪ থেকে ৬০ বছর)। কর্মজীবন শেষ হলে যাঁদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, পেনশন নেই, তাঁদের অবসরের সংস্থান নিজেদেরই করতে হবে, আয় যত সামান্যই হোক।
এইচডিএফসি-তে খোলা যেতে পারে সিস্টেমেটিক সেভিংস অ্যাকাউন্ট। যাঁরা বেশি করের আওতায় পড়েন, তাঁরা দীর্ঘ মেয়াদে টাকা জমাতে পারেন পিপিএফ অ্যাকাউন্টে, যেখানে সুদ (বর্তমানে ৮.৮%) পুরোপুরি করমুক্ত।
প্রসঙ্গত, সঞ্চয়ের প্রথম সোপান হল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। আয় নগদে পেলে তার পুরোটাই খরচ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ঘরে নগদ জমানোটাও ঠিক নয়। এতে সুরক্ষা এবং সুদ কোনওটাই থাকে না। আয় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করলে তার কিছুটা হলেও পড়ে থাকে। এতে জমানোর উৎসাহ বাড়ে। সুদও পাওয়া যায়। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া চেক ভাঙানো যায় নিজের অ্যাকাউন্টে। সঞ্চয়ে উৎসাহ দিতে কেন্দ্রীয় সরকার চায় প্রত্যেক পরিবারে অন্ততপক্ষে একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হোক। ২০০০ মানুষ থাকেন, এমন প্রতিটি গ্রামে যেন একটি করে ব্যাঙ্ক খোলা হয়। এতে সরকারি অনুদান, ১০০ দিনের কাজ ইত্যাদির টাকা সরাসরি প্রাপকের অ্যাকাউন্টে দেওয়া যাবে। মাঝপথে টাকা উধাও হয়ে যাওয়ার ভয় থাকবে না।
এ ব্যাপারে একটি বড় প্রচেষ্টা শুরু করেছে ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ক। কোনও রকম ন্যূনতম জমার শর্ত ছাড়াই এখন থেকে স্টেট ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে। ফলে অতি কম আয়ের মানুষও অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ পাবেন। এ দেশে স্টেট ব্যাঙ্কের শাখা সংখ্যা ১৪ হাজারেরও বেশি। এ ছাড়া ব্যাঙ্কের প্রত্যেক অ্যাকাউন্ট হোল্ডার সুযোগ পাবেন মাত্র ১০০ টাকা প্রিমিয়ামে ৪ লক্ষ টাকা মূল্যের দুর্ঘটনা বিমা পলিসি কেনার। এতে অবশ্যই উপকৃত হবেন অসংখ্য মানুষ, বিশেষত যাঁরা বাইরে কাজ করেন এবং যাঁদের দুর্ঘটনায় পড়ার সম্ভাবনা বেশি। যেমন ড্রাইভার, হকার, সেলসম্যান, কারখানাকর্মী, নির্মাণকর্মী। প্রিমিয়াম পড়বে দৈনিক ৩০ পয়সার কম।
অল্প করে নিয়মিত টাকা জমাতে কম আয়ের মানুষেরও বড় চাপ পড়ে না। কিন্তু তা শেষ জীবনের সম্বল গড়ে দেয়। পাশাপাশি প্রয়োজন ন্যূনতম দুর্ঘটনা বিমা এবং স্বাস্থ্য বিমারও। সামর্থ্যে কুলোলে ছোট করে একটি জীবনবিমা করে রাখতে পারলে পরিবার ন্যূনতম সুরক্ষা পাবে। |