গোসাবার সাতজেলিয়ার তমা বৈদ্য ই-বিটা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। সাত বছরের তমার হিমোগ্লোবিনের মাত্রা নেমে গিয়েছিল পাঁচ-এ। তাকে চার সপ্তাহ অন্তর রক্ত দিতে হত। বছরখানেক আগে চিকিৎসকের পরামর্শে দিনে দু’গ্লাস করে কচি গম গাছ থেঁতো করা রস খাওয়ানো শুরু হয় তাকে। তমার বাবা, পেশায় স্কুলশিক্ষক ভবতোষ বৈদ্য জানালেন, গত এক বছরে মেয়েকে এক বারের জন্যও আর রক্ত নিতে হয়নি।
কাঁথির মুকবেড়িয়া গ্রামের ১২ বছরের অম্লানকুসুম ভুঁইয়াও আক্রান্ত ই-বিটা থ্যালাসেমিয়ায়। তাকে রক্ত দিতে হত ১৫ দিন অন্তর। ২০১০ সাল থেকে দু’বেলা কচি গম গাছের রস খাওয়া শুরু করে সে। অম্লানের বাবা গৌতম ভুঁইয়ার বক্তব্য, “এক বছর ছেলেকে রক্ত দিতে হয়নি। ২০১০-এর জুলাইয়ের পরে রক্ত দিতে হয় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে। এর পরে আবার অম্লানকে রক্ত দিতে হয় ২০১২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর।” অর্থাৎ, ১৫ দিন অন্তরের জায়গায় অম্লানের রক্ত প্রয়োজন হওয়ার সময়ের ব্যবধান বেড়েছে অনেকটাই। কচি গম গাছ থেঁতো করে নিংড়ে বার করা এক গ্লাস করে রস সকাল-বিকেল খাওয়া। আর তাতেই লোহিত রক্তকণিকার ভাঙন কমে অম্লান বা তমা-র মতো ই-বিটা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত বহু শিশুর রক্ত নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কমছে বলে দাবি করছেন সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসক-গবেষকদের একটা বড় অংশ।
ভারত সরকারের ‘ন্যাচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর আয়ুর্বেদিক ড্রাগ ডেভেলপমেন্ট’, কলকাতার ‘নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল’ এবং কলকাতারই ‘নেতাজি সুভাষ ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার’ একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল ২০০ জন ই-বিটা থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুর উপর। |
|
|
তমা বৈদ্য |
অম্লানকুসুম ভুঁইয়া |
|
এর জন্য টাকা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ’ বিভাগ। ওই শিশুদের তিন থেকে ছয় সপ্তাহ অন্তর রক্ত দিতে হত। সাত-আট দিন বয়সী গমগাছ থেঁতো করে রস বানিয়ে রোজ দু’গ্লাস করে খাওয়ানো শুরু হয় প্রত্যেককে।
গবেষকদের অন্যতম, হেমাটোলজিস্ট আশিস মুখোপাধ্যায় জানালেন, ৬ মাস পর থেকে দেখা যায়, এদের মধ্যে ১৮০ জনের (অর্থাৎ প্রায় ৮০ শতাংশ শিশুর) রক্ত নেওয়ার সময়ের ব্যবধান বেড়ে গিয়েছে। অনেককে টানা এক বছর পর্যন্ত রক্ত দিতেই হয়নি। গত মাসেই এই সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে ‘ইউরোপিয়ান জার্নাল অফ মেডিসিনাল প্লান্টস্’-এ। এর পরেই রিপোর্টটি স্বাস্থ্যমন্ত্রকে পাঠানো হয় এবং গম গাছের রস নিয়ে যাতে সরকারি স্তরে আরও বড় আকারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় সে জন্য সুপারিশও করা হয়। প্রসঙ্গত, আগেও চণ্ডীগড়ে ‘পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’ (পিজিআই, চণ্ডীগড়) থেকে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তদের উপরে গম গাছের রসের প্রভাব নিয়ে গবেষণা হয়েছিল। তাতেও একই রকম ফল মিলেছে। ওই সমীক্ষার প্রধান গবেষক তথা পিজিআই, চণ্ডীগড়ের পেডিয়াট্রিক্স বিভাগের হেমাটো-অঙ্কোলজিস্ট রামকুমার মারওয়া বললেন, “গম গাছের রস নিয়মিত খেলে লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে শরীরে আয়রন জমে না, সে প্রমাণ আমরা পেয়েছি। ভারতের মতো দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই দরিদ্র। থ্যালাসেমিয়ার মতো রোগ হলে বেশির ভাগই মানুষই সন্তানের চিকিৎসা চালাতে পারেন না। তাঁদের বলতে গেলে মৃত্যুর জন্যই ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রাকৃতিক কোনও উপাদানের সাহায্যে রক্ত নেওয়ার ব্যবধান কমানো গেলে তা যুগান্তকারী হতে পারে।”
ই-বিটা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে ঠিক কী ভাবে কাজ করে কচি গমগাছের রস? এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ন্যাচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর আয়ুর্বেদিক ড্রাগ ডেভেলপমেন্ট’-এর ডিরেক্টর শুভ্রা মণ্ডল ও নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের বায়োকেমিস্ট্রির চিকিৎসক মনোজ কর বললেন, “কচি গমগাছে এমন তিনটি যৌগ পাওয়া গিয়েছে যার মাধ্যমে লোহিত রক্তকণিকার ভাঙন আটকানো যায়। এতে রক্তকণিকা ভেঙে থ্যালাসেমিয়া রোগীর দেহের বিভিন্ন অংশে লোহা জমা হতে পারে না। ফলে তাদের রক্ত নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও কমে যায়।”
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের হেমাটোলজিস্ট প্রসূন ভট্টাচার্য বললেন, “কচি গমগাছের রস নিয়মিত খেলে মানুষের রক্তে ‘ফিটাল হিমোগ্লোবিন’ বাড়ে তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত।” মূলত এই ধরনের হিমোগ্লোবিনের অক্সিজেন ধরে রাখার ক্ষমতা বেশি বলেই রক্তকণিকা কম ভাঙে। আর তাতেই রক্ত দেওয়ার প্রয়োজনও কমে, জানালেন প্রসূনবাবু। তবে ধারাবাহিক ভাবে রস খেলেই এই ফল পাওয়া যায়। আপাতত তাই প্রথাগত চিকিৎসার পাশাপাশি নিয়মিত কচি গমগাছের রস খাওয়াটাকেও সুস্থ হয়ে ওঠার অন্যতম চাবিকাঠি বলে ভাবছেন চিকিৎসকরা। |