শ্বেত পাথরের পোর্টিকোয় আবির ছড়িয়েছে কিছু। প্রশস্ত হল ঘরে ইতিউতি জটলা। থমথমে মুখ। প্লাস্টিকের চায়ের কাপ ‘চিনি কম’ বলে অনেকেই ফেলে দিচ্ছেন। সকালের আবিরও ঠোঙা বন্দি হয়ে কখন তাকে উঠে গেছে।
হল কী? ‘‘ধুর্ ভাল লাগছে না। লিডটা পড়ে আসছে রে!’’
দুপুরটা বিকেলের গড়াতে ক্রমেই ভারী হয়ে আসছে যেন দেউলির সাদা প্রাসাদটা।
ঝরঝরে রোদ্দুরেও গুম হয়ে আছে পরিবেশ। আলগোছে হাওয়াই চটি পরে তিনিও খানিক এ ঘর-ও ঘর করে ছাদের সিঁড়ি ধরতেই কেউ একটা খবর দিলেন, “দাদা, ষোলো রাউন্ড শেষে দু’হাজারের মতো লিড।” বেজার মুখে ছাদে না উঠে নেমে এলেন তিনি। তারপর প্লাস্টিকের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লেন।
শনিবারের সোয়া দু’টোর এমন গোমড়ামুখো দুপুরটা আচমকাই আশ্বিনের সোনা রোদে ঝলসে উঠল পাক্কা এক ঘণ্টা পরে। “দাদা...জি-তে গে-ছি। মার্জিন ২৫৩৬ ভোট।” থমকে থাকা বাড়িটা প্রথম বারের জন্য খোলস থেকে বেরিয়ে এল। কেউ এক জন ছুট্টে এসে তাঁর কপালে এঁকে দিলেন গোলাপি রঙের আবির-তিলক। পাশের ঘর থেকে চশমার কাচ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন তাঁর স্ত্রী চিত্রলেখা। আর তিনি, ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবির হাতা থেকে আঙুলের টোকায় আবির ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালেন জঙ্গিপুরের কংগ্রেস প্রার্থী। মাঝারি গড়নের রাষ্ট্রপতি-পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের মুখে তখন প্রলম্বিত হাসি।
সাকুল্যে আড়াই হাজার ভোটে জয়, হোক না। অভিজিৎ বলছেন, “জয় জয়-ই। তা লক্ষ ভোটে হোক আর এক হাজারে!” স্পষ্টই খুশি তিনি। ততক্ষণে খুলে গিয়েছে লাল ফিতের লাড্ডুর বাক্স। প্রণাম আর হাত মেলানোর হিড়িকও শুরু হয়ে গিয়েছে। উড়ে আসছে মিডিয়ার অনুরোধ, “বৌদি, আপনি দাদাকে একটা লাড্ডু খাইয়ে দিন না!”
ঠিক সেই সময়ে, রঘুনাথগঞ্জের নিতান্তই ছাপোষা পার্টি অফিসে মোবাইলটা কান থেকে নামিয়ে মুজাফ্ফর হোসেন বললেন, “এটা হার নয় হে, জিত-ই ধরো। গিরিয়া, সেকেন্দ্রায় ওই রিগিংটা ওরা না করলে আমরা হারি? কমরেড ভেঙে পড়ার কিছু নেই।” তারপর চেয়ে নিলেন, “কই হে, বাবলু একটু চা হবে নাকি?” তিনি সিপিএম প্রার্থী।
মুজাফ্ফরের শনিবারটা অবশ্য এ ভাবে শুরু হয়নি। সাত সকালে স্নান সেরে গণনা কেন্দ্রে ঢুকেই তিনি দেখেছিলেন প্রথম রাউন্ডেই ১১৬১ ভোটে এগিয়ে গিয়েছেন তিনি। পোড় খাওয়া মানুষটা অবশ্য তাতে উৎফুল্ল নয়, বরং ‘কমরেড’দের সতর্ক করে দিয়েছিলেন, “এখনও গিরিয়া-সেকেন্দ্রা বাকি।” রঘুনাথগঞ্জের ওই দুই এলাকায় অন্তত গোটা কুড়ি বুথে ‘ব্যপক রিগিং’-এর অভিযোগ নির্বাচনের পর থেকেই করে আসছিল সিপিএম। জিতছেন তো? সংবাদ মাধ্যমের প্রশ্নে তাই সকাল থেকেই তাঁর সতর্ক উত্তর ছিল, “দাঁড়ান সবে তো শুরু। গিরিয়া, সেকেন্দ্রা গাঁটটা পার হোক, তারপরে বলা যাবে।” দিনান্তে পার্টি অফিসে বসেও কর্মীদের তাই বলছেন, “কংগ্রেস ও তৃণমূলের তিনটি বিধানসভা ছিনিয়ে নিতে পেরেছি। এটা ভাল লক্ষণ। মানুষ আবার ফিরছে আমাদের দিকে।” তারপর পাঞ্জাবির হাতায় মুখ মুছে ফিরে যাওয়ার আগে যোগ করছেন, “কমরেড ভেঙে পড়ার কিছু নেই, ফের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হন, সামনে পঞ্চায়েত ভোট আছে কিন্তু।” কর্মীদের হাততালিতে ভরে উঠল আলো-আঁধারি পার্টি অফিস।
রঘুনাথগঞ্জ শহরের লাগোয়া দেউলির বাড়ি থেকে ততক্ষণে নিজেই জিপ চালিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন অভিজিৎবাবু। সঙ্গে স্ত্রী আর অত্যুৎসাহী অনুগামীরা। নিজেই জিপ চালিয়ে কিছুটা এগোতেই অবশ্য বিপত্তি। টায়ার ফেটে থমকে গেল গাড়ি। খানিক অপেক্ষার পরে বাড়ি থেকে ছুটে এল অন্য গাড়ি। স্ত্রীকে নিয়ে এক লাফে তাতেই চড়ে বসলেন অভিজিৎ। গন্তব্য সটান গণনা কেন্দ্রে। ঝাড়া পঞ্চাশ মিনিট পরে সেখান থেকে বেরিয়ে হাসি মুখে হাত জোড় করে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের ভিড় ঠেলে এ বার গন্তব্য গঙ্গা-বক্ষ। হ্যাঁ, নৌকাতেই দলীয় কর্মীদের সঙ্গে নিভৃত আলোচনা সারলেন তিনি।
সন্ধে নামছে। আলো-আঁধারির জঙ্গিপুরের আকাশে হাউই উড়েছে। মাঝে মধ্যে পটকার শব্দ। রাষ্ট্রপতি-পুত্র নির্দেশ দিলেন, “এ বার তীরে ভেড়াও নৌকা!” |