রাজ্যে উত্থান বিজেপি-র
হারেও আলোর রেখা দেখছে বাম
হারতে হারতেই কোনও রকমে জয়ের মুখ দেখলেন প্রণব-পুত্র। একটা সময় পর্যন্ত এগিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত হার মানলেন সিপিএম-প্রার্থী। আর জয়-পরাজয়ের এই অঙ্কের মধ্যে এ রাজ্যে বড় শক্তি হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিয়ে রাখল বিজেপি।
একনজরে জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক চালচিত্রের এই ছবিটাই তুলে ধরল। যা থেকে আপাতদৃষ্টিতে ইঙ্গিত মিলছে আগামী লোকসভা নির্বাচনের সময় যত এগোবে, বিজেপির বাম-বিরোধী ভোট টানার এই প্রবণতা বজায় থাকলে আখেরে ফায়দার সম্ভাবনা বামেদেরই।
এ দিনও যেমন হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৯ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায় জিতেছিলেন ১ লক্ষ ২৮ হাজার ভোটে। আর এ দিন তাঁর ছেলে অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় জিতলেন ২ হাজার ৫৩৬ ভোটে।
২০০৯ সালে লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভাতেই এগিয়ে ছিল কংগ্রেস-তৃণমূল জোট। তার দু’বছর পরে বিধানসভা নির্বাচনে ওই সাতটির মধ্যে মাত্র একটি আসনে জিতেছিল সিপিএম। আর শনিবার অভিজিৎবাবু তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএমের মোজফ্ফর হোসেনের থেকে পিছিয়ে রইলেন চারটি কেন্দ্রে! সব মিলিয়ে অভিজিৎবাবু যেখানে পেয়েছেন ৩৯.০১% ভোট, মোজফ্ফর পেলেন ৩৮.৭১%। এই ফলাফলকে দিনের শেষে তাদেরই ‘নৈতিক জয়’ বলে দাবি করেছেন সিপিএম নেতৃত্ব।
অন্য দিকে, ১৯৯১ সালের পরে প্রথম বার এই রাজ্যে ভোটের হার দু’অঙ্কে নিয়ে যেতে পেরেছে বিজেপি। জঙ্গিপুরে তাদের প্রার্থী সুধাংশু বিশ্বাস পেয়েছেন ৮৫ হাজার ৮৮৭ ভোট, শতাংশের বিচারে ১০.০১!
জয়ের পরে অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়
পরিসংখ্যানের এই খুঁটিনাটিকে সহজ ভাবে বিশ্লেষণ করলে যা স্পষ্ট গত বছরের বিধানসভার মতো মেরুকরণের ভোট এখন অতীত। বাম-বিরোধী আর বামপন্থী ভোটের তীব্র বিভাজন রাজ্যের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ধরে রাখা আর অত সহজ নয়। বরং উল্টো দিকে, বিজেপি এবং দু’টি স্বল্পপরিচিত দলের উত্থান বামেদেরই সুবিধা করে দিয়েছে। বিজেপি যেমন জঙ্গিপুরে ১০.১% ভোট পেয়েছে, তেমনই সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীদের এসডিপিআই এবং আরও একটি ছোট দল ডব্লিউপিআই (প্রসঙ্গত দু’টিই সংখ্যালঘু সংগঠন) মিলে ১১.৭১% ভোট কেটে নিয়েছে। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের মতে, এই ফলাফলের জেরে ছোট দলগুলি আরও বেশি করে প্রার্থী দিতে উৎসাহিত হবে। সঙ্গত কারণে বামেরাও তা-ই চাইবে। এমনিতে বামেদের ভোটের হার কমতে কমতে যেখানে গিয়ে ঠেকেছে, তার পরে আর খুব বেশি পিছনোর জায়গা অন্তত এখনই নেই (যদিও গত বিধানসভার চেয়ে এই লোকসভা উপনির্বাচনে বামেদের ভোটের হার সামান্য কমেছে)! এর পরে ভোট কাটাকাটিতে যা ফায়দা হওয়ার, বামেদেরই হওয়ার কথা। যেমন হত অতীতের পশ্চিমবঙ্গে।
কংগ্রেসের অভিযোগ, বিচ্ছেদের পরে ভোটবাক্সে তৃণমূলের সমর্থন পাননি অভিজিৎ। সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব অবশ্য মনে করছেন, তৃণমূল নিজেদের সমস্ত ভোট সংগঠিত ভাবে কংগ্রেস বাদে অন্য কারও পক্ষে ফেলবে এতটা ভেবে নেওয়া ঠিক নয়। তেমন করার ক্ষমতা তাদের আছে কি না সন্দেহ। বরং, জঙ্গিপুরের কংগ্রেস প্রার্থীর পরিচয় রাষ্ট্রপতি-পুত্র না-হলে সিপিএমই জয়ের হাসি হাসত। একই সঙ্গে সিপিএম নেতৃত্ব দাবি করছেন, কেন্দ্রে মনমোহন সিংহের নীতির বিরুদ্ধে জেহাদের কথা বলে রাজ্যে লোকসভা উপনির্বাচনে সৌজন্য দেখিয়ে প্রার্থী না-দেওয়া, তৃণমূলের এই ‘দ্বিচারিতা’ মানুষ সমর্থন করেননি। সব থেকে বড় কথা, এ দিনের ভোটে কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপি সকলেরই এক দফা পরীক্ষা হয়ে গেল। শুধু পরীক্ষায় বসেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটা তাদের মাথাব্যথার কারণ হতেই পারে। তবে তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য, রাষ্ট্রপতি-পুত্র বলেই তাঁরা প্রার্থী দেননি। ভোট-ময়দানে ঠিক কী করতে হবে, সে ব্যাপারে তৃণমূল কর্মীদের জন্য কোনও ধরাবাঁধা নির্দেশও ছিল না। ঘনিষ্ঠ মহলে অবশ্য মমতা বলছেন, জঙ্গিপুরের এই ফল থেকে কংগ্রেসের শিক্ষা নেওয়া উচিত। তারা যে দ্রুত জনসমর্থন হারাচ্ছে, এ বারের ফল তারই ইঙ্গিত বলে মমতা মনে করছেন।
কংগ্রেস-তৃণমূলের এই পারস্পরিক বিবাদের মধ্যেই দু’দলের কাছে কাঁটা হিসেবে রয়ে যাচ্ছে বিজেপি। তৃণমূল নেত্রী হয়তো মানতে চাইবেন না, কিন্তু এ রাজ্যে বিজেপি-র উত্থান এখন বাস্তব। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের ব্যাখ্যায়, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু এলাকায় গড়ে ৪ থেকে ৬ শতাংশ ভোট পেত। ২০১১-র মেরুকরণের ভোটে সেটুকুও তারা পায়নি। এই উপনির্বাচনে সেই ঐতিহ্যগত ভোটব্যাঙ্ক পুনরুদ্ধার ছাড়াও সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কংগ্রেস-বিরোধিতার হাওয়ারও কিছু ফায়দা তারা পেয়েছে। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস তৈরির জন্য উচ্ছেদের প্রতিবাদে গ্রামবাসীদের আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়ানোও তাদের পালে কিছুটা বাতাস দিয়েছে স্থানীয় ভাবে।
এত কষ্ট করে কেন জিততে হল কংগ্রেসকে? অভিজিতের বক্তব্য, “অনেক মানুষ জেলার বাইরে আছেন। তাঁদের
ভোটের একটা বড় অংশ আমরা পেতাম। সেটা বাদ দিয়েই হিসেব করতে হবে।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের মতে, “তার উপরে আবার অসমের অশান্তি-সহ সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে এই ভোট লড়ে জিততে হয়েছে কংগ্রেসকে!” শেষ পর্যন্ত জঙ্গিপুরে রাষ্ট্রপতি-পুত্রের ভোট বৈতরণী পেরোনোকে বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরীর সাংগঠনিক ক্ষমতার জয় বলেও মন্তব্য করেছেন প্রদীপবাবু।
অভিজিতের প্রতিদ্বন্দ্বী মোজফ্ফরের কথায়, “রাষ্ট্রপতির নাম ভাঙিয়েই ভোটটা করা হল! টাকা খরচ হল, সন্ত্রাস হল। আমরা গরিব মানুষকে একজোট হওয়ার ডাক দিয়েছিলাম। সেই ডাকে মানুষ অনেকটাই সাড়া দিয়েছেন।” মোজফ্ফরের অভিযোগ, জঙ্গিপুরের ১৬টি বুথে অবাধ ভোট হয়নি। সিপিএমের পঞ্চায়েত প্রধান আছেন, এমন এলাকার বুথেও তিনি শূন্য ভোট পেয়েছেন! এই খতিয়ান তুলে ধরে সোমবার হাইকোর্টে যাচ্ছে সিপিএম, জানালেন মুর্শিদাবাদ জেলা সিপিএম সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেব বলেছেন, “নৈতিক জয় হয়েছে বামফ্রন্টেরই। জনবিরোধী নীতি নিয়ে চলা কংগ্রেসের নৈতিক পরাজয় হয়েছে। গত বছর আমরা শুধু নবগ্রাম বিধানসভা জিতেছিলাম। এ বার তার সঙ্গে কংগ্রেসের হাতে-থাকা জঙ্গিপুর ও সূতি এবং তৃণমূলের দখলে-থাকা সাগরদিঘিতেও আমাদের প্রার্থী এগিয়ে রয়েছেন।” রবীনবাবুর আরও বক্তব্য, “জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছেও কোথায় খামতি থেকে গেল, আমরা পর্যালোচনা করব।”
তবে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য বলছেন, “সামান্য ভোটে এই হারে আমাদের আখেরে ভালই হয়েছে! কংগ্রেস হেরে গেলে জোটের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে দিল্লি এবং কলকাতায় নতুন করে ভাবনাচিন্তা জোরদার ভাবে শুরু হয়ে যেত। তার চেয়ে এখন তৃণমূল নেত্রী কংগ্রেসকে এবং কংগ্রেস তৃণমূলকে বার্তা দিতে ব্যস্ত। আমাদের শুধু নিজেদের কাজটা করে যেতে হবে!”
ভোট-কাটাকাটির জটিল আবর্তেই আপাতত রুপোলি রেখা দেখার চেষ্টা করছে সিপিএম!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.