আর মাত্র কয়েকটা দিন। সাজা ঘোষণা হয়ে যাবে। শেষ লগ্নে একটা শেষ চেষ্টা!
‘মাননীয় বিচারক, মিস্টার গুপ্ত মানুষটা কিন্তু ভাল!’
বিচার শুরুর আগে রজত গুপ্তের সমর্থনে মুখ খুলেছিলেন মুকেশ অম্বানী-সহ এ দেশের শীর্ষ শিল্পপতিরা। আদালতের রায় ঘোষণার মুখে এ বার রজত গুপ্তের পাশে দাঁড়াতে শুরু করলেন দুনিয়ার তাবড় ব্যক্তিত্ব। মাইক্রোসফ্টের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রাক্তন মহাসচিব কোফি আন্নান, সরাসরি বিচারপতির কাছে চিঠি লিখেছেন। যার মূল কথাটা হল দোষ করে থাকলে শাস্তি তো হবেই, কিন্তু মানুষটার ভাল দিকগুলো যেন ভুলে থাকা না হয়!
কী রকম ভাল দিক?
দুনিয়া জুড়ে এডস-টিবি-ম্যালেরিয়ার মতো মারণ অসুখ রুখতে গেটস ফাউন্ডেশন গড়েছেন বিল। সেখানে তাঁর সঙ্গে একযোগে কাজ করেছেন রজতবাবু। সে কথা উল্লেখ করে বিল লিখেছেন, “বিশ্বে লক্ষ লক্ষ মানুষ যে একটু ভাল থাকার সুযোগ পাচ্ছেন, বা বলা ভাল আদৌ বেঁচে আছেন, তাতে অবদান রয়েছে রজতের।” আরও লিখেছেন, ‘‘আমি খুব ব্যক্তিগত ভাবে জানি, রজত গুপ্তের মধ্যে সারা পৃথিবীর দরিদ্র মানুষ তাদের এক যোগ্য মুখপাত্র খুঁজে পেয়েছে।”
প্রায় একই কথা লিখেছেন শান্তির নোবেলজয়ী আন্নানও। রাষ্ট্রপুঞ্জের পরামর্শদাতা হিসেবে তাঁর সঙ্গেও কাজ করেছেন রজতবাবু। আন্নানের আর্জি, “জীবনে দীর্ঘ সময় ধরে যে ভাল কাজ রজত করেছেন, তা-ও একই রকম গুরুত্ব দিয়ে দেখা হোক। দেওয়া হোক তার প্রাপ্য কৃতিত্ব। মনে রাখা হোক, বহু লক্ষ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে তাঁর অক্লান্ত চেষ্টাকে।”
গোল্ডম্যান স্যাক্সের পরিচালন পর্ষদে থাকাকালীন গোপন তথ্য পাচারের দায়ে জুন মাসে রজতবাবুকে দোষী সাব্যস্ত করে মার্কিন আদালত। আইন অনুযায়ী, এ জন্য ২৫ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে তাঁর। সম্ভবত আগামী ২৪ তারিখই সাজা ঘোষণা করবে আদালত। কর্পোরেট দুনিয়ার অন্যতম ‘গ্ল্যামার বয়’-এর হাজতবাসের মেয়াদ স্পষ্ট হয়ে যাবে বিজয়া দশমীতেই। |
কিন্তু তার আগে মার্কিন জেলা আদালতের বিচারক জেড র্যাকফের ডাক- বাক্স ভরে উঠেছে প্রায় ২০০ চিঠিতে। এ দিনই তা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করেছেন তিনি। রজতবাবুর স্ত্রী, চার মেয়ে এবং বন্ধুরা চিঠি পাঠিয়েছেন। প্রচুর চিঠি এসেছে বিশ্বের বহু নামীদামি ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে। শুধু বিল গেটসের মতো শীর্ষ কর্পোরেট কর্তা নন, চিঠি দিয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা অধ্যাপকরা। সবারই অনুরোধ, রজতবাবুর ভাল কাজের খতিয়ানটাও মাথায় রাখা হোক।
বস্তুত সব চিঠিরই মূল বয়ান মোটামুটি এক। প্রেরকেরা সকলেই কমবেশি মনে করেন, বিচারের সময় সে ভাবে সামনে আসেনি রজতবাবুর ভাল দিকগুলো। ফুটে ওঠেনি সমাজের প্রতি তাঁর বরাবরের দায়বদ্ধতার কথা। রজতবাবুর স্ত্রী অনিতা গুপ্ত যেমন লিখেছেন, “জানি আদালতের সিদ্ধান্ত মানতেই হবে। কিন্তু বিশ্বাস করি, আমার স্বামী কে বা কেমন, তা সামনেই আসেনি বিচারের সময়।”
রজতবাবুর বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ ছিল, তাঁর কাছে পাওয়া গোপন তথ্য কাজে লাগিয়েই বেআইনি শেয়ার কেনা-বেচায় বিপুল মুনাফা করেছে হেজ-ফান্ড সংস্থা গ্যালিয়ন। ওয়ারেন বাফের বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের ৫০০ কোটি ডলার লগ্নির সিদ্ধান্ত তাদের গোপনে জানিয়ে দিয়েছিলেন রজত। গ্যালিয়নের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন কর্ণধার শ্রীলঙ্কার রাজ রাজারত্নম আপাতত ১১ বছরের জন্য হাজতে। আর যে সংস্থার টাকা ঢালার কথা জানানো নিয়ে বিতর্ক, রজতবাবুর পক্ষে কলম ধরেছেন সেই বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ের অন্যতম কর্তা অজিত জৈনও। লিখেছেন, “ইতিমধ্যেই যথেষ্ট শাস্তি পেয়েছেন রজত।” মনে করিয়ে দিয়েছেন, এই রজত গুপ্তের কাছ থেকেই কল্যাণমূলক কাজের প্রেরণা পেয়েছেন তিনি।
ভারতের শীর্ষ শিল্পপতিদের সমর্থন বিচার শুরুর আগেই পেয়েছেন রজতবাবু। প্রাক্তন ম্যাকিনসে কর্তা রজতের সমর্থনে ওয়েবসাইটও তৈরি করেছিলেন রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর কর্ণধার মুকেশ অম্বানী, গোদরেজ গোষ্ঠীর শীর্ষ কর্তা আদি গোদরেজ, আইটিসি-র চেয়ারম্যান যোগী দেবেশ্বর, ডিএলএফ চেয়ারম্যান কে পি সিংহ প্রমুখ। রিলায়্যান্স কর্ণধারের বক্তব্য ছিল, “দু’দশক ধরে রজতকে চেনার সূত্রে বলতে পারি যে, তাঁকে কখনও নিজের জন্য কিছু চাইতে দেখিনি। বরং ভাবতে দেখেছি দেশ ও দশের জন্য।”
এ সব না-হয় কর্পোরেট দুনিয়ার সওয়াল! রজতের বিচার আর রায় ঘোষণাকে ঘিরেও কিন্তু আবেগের বিস্ফোরণ ছিল চোখে পড়ার মতো। রজতবাবুকে দোষী ঘোষণা করে আদালতের বাইরে এসে কেঁদে ফেলেছিলেন দুই জুরি সদস্যও। জানিয়েছিলেন, বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে যে, সাফল্যের চূড়া থেকে এমন করে কেউ মুখ থুবড়ে পড়তে পারেন। বহুজাতিকের বোর্ড রুম থেকে কারও গন্তব্য হতে পারে জেলের কুঠুরি।
সত্যিই। ৫৩ বছর বয়সী রজত গুপ্ত পদ হারিয়েছেন, ক্ষমতা হারিয়েছেন, সম্মান হারিয়েছেন। কিন্তু শুভাকাঙ্ক্ষীদের হারাননি। বিল গেটস থেকে কোফি আন্নানের মতো হেভিওয়েটরা আজও তাঁর পাশে। |