হিসেব দেখে মাথা ঘুরে গিয়েছিল স্বাস্থ্যকর্তাদের। মেদিনীপুরের এক হাসপাতালে এক বছরে শুধু ফিনাইলই কেনা হয়েছে ৬১ লক্ষ টাকার! ৭৭ লক্ষ টাকার কীটনাশক স্প্রে কিনেছে বর্ধমানের এক হাসপাতাল। কলকাতার এক হাসপাতালে হজমের ওষুধ কিনতে খরচ হয়েছে ৮৯ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে অধিকাংশেরই মেয়াদ ফুরোতে বাকি ছিল মাত্র কয়েক মাস। বছর ঘোরার আগেই তাই বিপুল পরিমাণ ওষুধ ফেলে দিতে হয়।
এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি। গলদ যে রয়েছে, তা সবাই জানতেন। কিন্তু গলদ দূর করার উপায়টা কী, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাননি। বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু চেষ্টা হলেও তা দানা বাঁধেনি। এ বার সরকারি হাসপাতালে ওষুধ-দুর্নীতি ঠেকাতে বিশেষ ব্যবস্থা চালু করল স্বাস্থ্য দফতর। স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, ভূত রয়েছে সর্ষের মধ্যেই। আর সেই ভূত তাড়াতে ‘তথ্যপ্রযুক্তি’ নামের ওঝার সাহায্য নিচ্ছেন তাঁরা। ‘স্টোর ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম’ নামে একটি নতুন ব্যবস্থা চালু করে সমস্ত স্তরে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা চলছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পর্যন্ত সব স্তরেই এই ব্যবস্থা চালু হবে। এ জন্য কর্মীদের প্রশিক্ষণও শুরু হয়ে গিয়েছে।
প্রশাসনে স্বচ্ছতা আনতে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ই-গভর্ন্যান্স চালুর কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুরু হয়েছে ই-টেন্ডারও। ‘স্টোর ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম’ তারই একটি ধাপ। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা জানান, এই নয়া ব্যবস্থায় কোন হাসপাতালে কোন ওষুধ কী পরিমাণে মজুত আছে, কোন ওষুধ কতটা প্রয়োজন, তার রেকর্ড থাকবে। ওষুধের বরাতও দেওয়া হবে সে ভাবেই। পাওনাও মেটানো হবে সরাসরি। ওষুধ সংস্থার সঙ্গে হাসপাতাল কর্তাদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রাখার প্রয়োজনই পড়বে না। সব তথ্যই ওয়েবসাইটে মজুত থাকবে বলে দক্ষিণ ২৪ পরগনার স্বাস্থ্যকর্তা কোন ওষুধ কত পরিমাণে চাইছেন, নিজের জেলায় বসেই জানতে পারবেন বর্ধমানের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক। কিংবা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে কোন ওষুধের কত স্টক আছে, তা জানতে পারবেন আর জি কর বা এস এস কে এমের সুপাররাও। রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ওষুধ কেনাকে কেন্দ্র করে বছরের পর বছর যে কোটি কোটি টাকা নয়ছয় চলে আসছে, এ ভাবেই তাতে লাগাম পরানো সম্ভব বলে স্বাস্থ্যকর্তাদের আশা।
স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, “অনেক সময়েই দেখা যেত, হাসপাতালে প্রয়োজনীয় ওষুধ মজুত নেই। কিংবা যে ওষুধ কাজেই লাগেই না, তার জন্য বিপুল খরচ হচ্ছে। এক শ্রেণির কর্মী এই চক্রে যুক্ত ছিলেন। এই ব্যবস্থায় সেই চক্রটা ভাঙা সম্ভব হবে। ওষুধকে নাগালের মধ্যে রাখতে ইতিমধ্যেই পিপিপি ফার্মেসি চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর হাসপাতালের নিজস্ব ফার্মেসিতে যাতে ওষুধ ঠিকঠাক থাকে, সে জন্য এই নতুন ব্যবস্থা চালু হচ্ছে। দুর্নীতির সুযোগই থাকবে না।”
অতীতে বহু ক্ষেত্রেই সময়মতো টাকা না মেটানোয় ওষুধ সরবরাহ বন্ধ করেছে একাধিক সংস্থা। তার পরে তদন্তে নেমে দেখা গিয়েছে স্বাস্থ্য ভবন টাকা বরাদ্দ করলেও স্থানীয় স্তরে তা আটকে থেকেছে। নতুন ব্যবস্থায় বিল আটকে রাখার সেই চেষ্টাও সফল হবে না বলে স্বাস্থ্যকর্তাদের দাবি। কারণ বিল কোন পর্যায়ে রয়েছে, বিক্রেতা সংস্থা সেটাও ওয়েবসাইটে দেখে নিতে পারবেন। স্বাস্থ্যকর্তাদের বক্তব্য, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে দুর্নীতির উৎসমুখটাই বন্ধ করে দিতে সক্ষম হবেন তাঁরা।
স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “দুর্নীতির শিকড়টা কত দূর ছড়িয়ে রয়েছে, তা ভাবা যায় না। এমন নজিরও আছে, যেখানে পেটি পেটি ওষুধ সরবরাহ করেছে কোনও একটি সংস্থা। অথচ কাগজে সই করে সেটা নিতে অস্বীকার করেছে হাসপাতালের লোকজন, ফিরিয়ে দিচ্ছে। কারণ তারা চায় অন্য সংস্থাকে বরাত দিতে। তাতে তাদের পকেট ভারী হবে। তাই স্বাস্থ্য দফতরে তারা ওই সংস্থার বিরুদ্ধে সময়মতো ওষুধ সরবরাহ না করার অভিযোগ আনছে।”
নতুন এই ব্যবস্থায় কি সেটা একেবারেই হবে না? স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, চোরাগোপ্তা চেষ্টা এখনও চলছে। এক কর্তার কথায়, “কোনও কোনও হাসপাতাল থেকে ওষুধ সংস্থার কর্তাদের ফোন করে বলা হচ্ছে, সবই কি আর কম্পিউটারে হয়? মুখ না দখলে কাজ হবে কি করে? এই মুখ দেখাতে চাওয়া মানেই আর্থিক লেনদেনের চেষ্টা। আমরা সমস্ত সংস্থাকে সতর্ক করে দিয়েছি। তেমন কিছু ঘটলে যেন সরাসরি অভিযোগ জানানো হয়।”
কিন্তু এই নিয়মকানুনের সবই তো স্বাস্থ্য দফতরের কর্মীদের জন্য। ওষুধের মান ঠিক রাখার জন্য সংস্থাগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে কী করে? স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, ওষুধের মান খারাপ হলে ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্ত করে তাদের নাম ওয়েবসাইটে প্রচার করে দেওয়া হচ্ছে। এই ব্যবস্থা ভবিষ্যতেও চালু থাকবে। এক বার কালো তালিকাভুক্ত হলে, ভবিষ্যতে সেই সংস্থাকে সুযোগ দেওয়া হবে না। |