|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
দুই গণতন্ত্র, এক উদ্বেগ |
জয়ন্ত সেনগুপ্ত |
অ্যাংজাইটিজ অব ডেমোক্র্যাসি: তোক্ভিলিয়ান রিফ্লেকশনস অন ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ইউনাইটেড স্টেট্স,
পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও আইরা ক্যাত্স্নেলসন সম্পাদিত। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ৭৫০.০০
|
উনিশ শতকের ত্রিশের দশকের গোড়ায়, ক্ষয়িষ্ণু অভিজাততন্ত্র আর প্রজাতান্ত্রিক ধ্যানধারণার এক নতুন জোয়ারের মাঝখানে ফরাসি রাজনীতি যখন খানিক দিশেহারা, সেই সময় তরুণ ফরাসি রাষ্ট্রচিন্তক ও ঐতিহাসিক আলেক্সি দ্য’তোক্ভিল পাড়ি দিয়েছিলেন অতলান্তিকের অন্য পারে পশ্চিম গোলার্ধের ‘নয়া দুনিয়া’র এমন একটি দেশে, গণতন্ত্রের বয়স যেখানে তখন সবে পঞ্চাশ পেরিয়েছে। বৃহৎ পুঁজির মৌরসিপাট্টা তখনও সে দেশে তেমন জাঁকিয়ে বসেনি। কিন্তু সর্বজনীন ভোটাধিকারের অন্তত শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের আগমনবার্তাও কান পাতলেই শোনা যায়। তোক্ভিল সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন গণতন্ত্রের এক অপ্রতিরোধ্য জয়যাত্রা, যেখানে সামাজিক সচলতা ও ধনার্জনের সম্ভাব্যতা সমান অধিকারের দাবিকে অনুসরণ করে, যে গণতান্ত্রিক আত্মপ্রত্যয় তাঁর স্বদেশ ফ্রান্সে, এক যুগান্তকারী বিপ্লবের উত্তরাধিকার সত্ত্বেও, তখনও সুদূরপরাহত।
কিন্তু এই ‘কিশোর’ গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে তোক্ভিলের উদ্বেগও কম ছিল না। এই ব্যবস্থা যে শুধুই শ্বেতাঙ্গদের জন্য, কৃষ্ণাঙ্গ বা আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের যে এতে ঠাঁই নেই, সেই বৈষম্য তাঁর চোখ এড়ায়নি। গণতান্ত্রিক নাগরিকত্ব আর সামাজিক অসাম্যের বোঝাপড়া কী ভাবে হবে, তা নিয়ে তোক্ভিল ছিলেন সংশয়াকুল। তাঁর ডেমোক্র্যাসিইনআমেরিকা (১৮৩৫) প্রকাশের পর পেরিয়ে গিয়েছে দু’শো বছর, এক কালো মানুষ এখন সে দেশে রাষ্ট্রপতি।
এরই পাশাপাশি ভারতেও পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের বয়স খুব বেশি দিন হল পঞ্চাশ পেরোয়নি। প্রায় এই বয়সেই তোক্ভিল পর্যবেক্ষণ করেছিলেন মার্কিন গণতন্ত্রকে। তাই তাঁর প্রশ্ন আর সংশয়গুলিকে ভারতীয় গণতন্ত্রের নিরিখে খানিক ভাগ করে নিতে পারি আমরাও। হিন্দু-মুসলিম, উচ্চবর্ণ-দলিত, শিক্ষিত-নিরক্ষর যে অসংখ্য সামাজিক ও ধর্মীয় বিভেদের ভিত্তিভূমিতে রচিত হয়েছিল সদ্যস্বাধীন ভারতের গণতন্ত্র, ষাট বছরে কী হাল দাঁড়িয়েছে সেগুলির? তোক্ভিলের আমেরিকা-সংক্রান্ত লেখায় দীর্ঘ ছায়া ফেলেছিল ফরাসি রাজনীতি, এই দুই দেশের বিবর্তনের ভিন্নতাকে সম্পূর্ণ স্বীকৃতি দিয়েই তোক্ভিল সন্ধান করেছিলেন গণতান্ত্রিক সমাজ ও মানসের ‘বিশ্বজনীন’ স্বাক্ষরগুলির। সেই একই ইতিহাস-সংবেদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আজকে আমরা কী ভাবে তুলনামূলক পর্যালোচনা করতে পারি পৃথিবীর এই দুই বৃহত্তম গণতন্ত্রের? এই বইয়ের প্রবন্ধগুলিতে রয়েছে এই প্রশ্নেরই বিবিধ উত্তরসন্ধান।
যেমন, তোক্ভিলের তত্ত্বের আলোকে সুদীপ্ত কবিরাজ দেখিয়েছেন গণতন্ত্রের সাংবিধানিক-রাজনৈতিক কাঠামো আর সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কটি ভারতে ক্রমান্বয়ে কী ভাবে টানাপড়েনের মাধ্যমেই প্রকাশিত হতে থাকে। সামাজিক সাম্য ও গণতন্ত্রের গভীর, ওতপ্রোত সম্পর্ক এবং সুশীল সমাজের মাধ্যমে নাগরিকত্বের আত্মপ্রতিষ্ঠা এই যে দুটি জিনিসকে তোক্ভিল মার্কিন গণতন্ত্রের দুই ভিত্তিপ্রস্তর ভেবেছিলেন, সেগুলি ভারতীয় গণতান্ত্রিক নাগরিকত্বের ইতিহাসে কতখানি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তার সুলুকসন্ধান করেছেন নীরজা গোপাল জয়াল। রাজীব ভার্গবের প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে হিন্দু ধর্মের ওপর গণতন্ত্রের অভিঘাত (প্রসঙ্গত, খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে একই আলোচনা করেছিলেন তোক্ভিলও)। এই প্রশ্নটি বিশেষ করে অতি জরুরি। হিন্দুধর্মের ওপর ঔপনিবেশিক আধুনিকতার প্রভাব, অথবা হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলেও, গণতন্ত্রের বিবর্তনের সঙ্গে এই ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে লেখালিখি হয়নি বললেই চলে।
একই রকম মূল্যবান অন্য এক প্রবন্ধে আশুতোষ ভার্শনে তোক্ভিলের অনুসরণে উপস্থাপনা করেছেন আর একটি জরুরি প্রশ্ন। তোক্ভিল লক্ষ করেছিলেন সামাজিক কাঠামো আর অর্থনৈতিক বিকাশের এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কসূত্র কেন্টাকি প্রদেশের ক্রীতদাস-নির্ভর সমাজব্যবস্থার নিগড়ে থমকে আছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অথচ একটি নদী পেরোলেই ও পারে ওহায়ো প্রদেশে দাসপ্রথার অনুপস্থিতিতে এক মুক্তমনস্ক সমাজ নিরন্তর প্রাণনা জুগিয়ে চলেছে শিল্পায়নের কাজকর্মকে। একই নিয়ম মেনে জাতপাতের প্রভাবের আঞ্চলিক তারতম্য অনুযায়ী উন্নয়ন-মনস্কতার তারতম্য কি ভারতীয় সমাজেও ঘটে? আশুতোষের লেখায় উঠে এসেছে এক চমকপ্রদ তথ্য: উত্তর ভারতের তুলনায় দক্ষিণে দলিত, অনুন্নত শ্রেণির আত্মপ্রতিষ্ঠার ইতিহাস অনেক পুরনো, জাতপাতের অচলায়তন ভেঙে তাই এ অঞ্চলে মুক্ত আর্থিক উন্নয়নের হাওয়া, নিম্নবর্গের বাণিজ্যমনস্কতা। কেন্টাকি আর উত্তর ভারত কোথাও যেন মিলে যায়, মার্কিন শিল্পায়নের অগ্রপথিক ওহায়োর ছায়া পড়ে বাণিজ্য-বান্ধব দক্ষিণ ভারতে।
১৮৩০-এর দশকের আমেরিকায় কৃষক ও শ্রমিকের সাবেক ভেদাভেদ ঘুচে যেতে দেখেছিলেন তোক্ভিল। যখন তিনি লক্ষ করেছিলেন যে বৃহৎ শিল্প-নির্ভর অর্থনীতির মধ্যে সম্পূর্ণ সেঁধিয়ে না গেলেও মার্কিন কৃষক চাষবাসের পাশাপাশি সোৎসাহে সাড়া দিচ্ছে অন্যতর বাণিজ্যিক পেশার আহ্বানে। এই চলিষ্ণুতার মধ্যেই গণতন্ত্র আর পুঁজিবাদের এক মেলবন্ধন প্রতিফলিত। কিন্তু ভারতীয় কৃষক? এই বইয়ের সম্ভবত সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রবন্ধে পার্থ চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন, সাম্প্রতিক ভারতে কর্পোরেট পুঁজিবাদের নিরন্তর আগ্রাসনের সামনে কোণঠাসা হয়েও কৃষক কী ভাবে রপ্ত করে নেয় গণতন্ত্রেরই নতুন কৃৎকৌশল, তার নিজস্ব দাবিদাওয়া নিয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে বোঝাপড়ার কায়দাকানুন। প্রান্তিক হয়ে পড়লেও রাষ্ট্র তাকে ফেলে দিতে পারে না। ভর্তুকি, পুনর্বাসন, বিবিধ রোজগার যোজনা ইত্যাকার প্রকল্পের মাধ্যমে তার সুরক্ষাকবচ তৈরি করে দিতে হয়। কৃষকও তা বিলক্ষণ জানে। তাই জমিদার-মহাজন-ব্যবসাদার ধরনের ‘সাবেক’ শ্রেণিশত্রুদের থেকে নিশানা ঘুরিয়ে সে তার সংগ্রামের যাবতীয় উদ্যম চেলে দেয় সরকার এবং নানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছ থেকে যথাসাধ্য ‘কল্যাণ’ আদায় করে নেওয়ার কাজে। এ এমন এক ধরনের বোঝাপড়া, যা যুগধর্মেই অনিয়মিত, পরিবর্তনশীল, পরিস্থিতি-নির্ভর। আধুনিক ভারতে, সরকারের সমস্ত স্তরের উপরেই কর্পোরেট পুঁজিবাদের ছায়া যখন ক্রমশই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। এ ভাবেই গণতন্ত্রের নতুন করণকৌশল আয়ত্ত করে টিকে থাকে কৃষকসমাজ। আগের বই পলিটিক্স্ অব দ্য গভর্নড-এ পার্থ দেখিয়েছিলেন ফুটপাতের হকার, ভবঘুরে, বেআইনি জবরদখলকারীদের মতো প্রান্তিক নিম্নবর্গীয়রা কী ভাবে সুশীল সমাজ বা মেনস্ট্রিম নাগরিকত্বের চৌহদ্দির বাইরে গড়ে তোলে এক নতুন রাজনীতির পরিসর (‘রাজনৈতিক সমাজ’), যেখানে রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের এক দৈনন্দিন বোঝাপড়া চলতে থাকে। সেই বক্তব্যের ছায়া এই প্রবন্ধেও।
প্রায় দুশো বছর আগে ফ্রান্স ও আমেরিকা সম্পর্কে তোক্ভিলের পর্যবেক্ষণে ভারতের কথা না থাকলেও, তাঁর তোলা অনেকগুলি প্রশ্নই ভারতীয় গণতন্ত্রের সম্পর্কে নতুন ধরনের গবেষণার দিকনির্দেশ করে। এর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি অবশ্যই ভারতের ‘গণতান্ত্রিকীকরণ’-কে একটি সামাজিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখার প্রচেষ্টা। সেই সঙ্গে নাগরিকত্বের ধারণাটিকেও নিছক রাষ্ট্রিক ও রাজনৈতিক সংজ্ঞায়নের বাইরে গিয়ে দেখার তাগিদ ভারতীয় গণতন্ত্রে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ এবং ‘বিচারবিভাগীয় অতিসক্রিয়তা’ নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কটিকে নিয়ে হয়তো এখানে আলোচনা করা যেত। ভারতীয় মুসলিম ও নারীসমাজ সম্পর্কে আলোচনা থাকলে হয়তো বইটি আরও সমৃদ্ধ হত। তবে এই অপ্রাপ্তিটুকু সার্বিক মূল্যের কাছে নেহাতই গৌণ। গণতন্ত্রের জয়গান আমরা সকলেই করি বটে, কিন্তু ‘গণতন্ত্রের উদ্বেগ’ সহজে যায় না। উদ্বেগের সেই মহাকটাহে টগবগ করে একই সঙ্গে ফুটতে থাকে পৃথিবীর দুই বৃহত্তম গণতন্ত্রের অসংখ্য দুরূহ, হয়তো বা অমীমাংসেয়, প্রশ্ন ঠিক কী অর্থে আমরা ‘ভারতীয়’ বা ‘আমেরিকান’? নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতার বাইরে কী ভাবে আমরা গণতন্ত্রের সামাজিক প্রক্রিয়াটিকে যথার্থ ভাবে লালন করতে পারি? একুশ শতকের দুনিয়ায় কে নেবে আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের স্বপ্নের দখলদারি? রাষ্ট্র? বাজার? নাগরিক সমাজ? সব প্রশ্ন দূরস্থান, বেশির ভাগ প্রশ্নেরই উত্তর মেলে না। তাতে ক্ষতিও নেই। কারণ, এই নিরন্তর সংশয়, এই প্রশ্নদীর্ণতা তো গণতন্ত্রেরই স্বধর্ম, সে-ই আমাদের প্রকৃত উত্তরাধিকার। সেই উদ্বেগ এই বই আবার চারিয়ে দিয়ে গেল। |
|
|
|
|
|