ডাকঘর

কল্পনাপ্রসূত তথ্য
২৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত আমার চিঠির প্রেক্ষিতে গত ৬ অক্টোবর প্রকাশিত দুটি চিঠি প্রসঙ্গে জানাই, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ভাষাতত্ত্ব, নন্দনতত্ত্ব, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, দর্শন, পুরাতত্ত্ব, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য এবং পড়াশোনার ব্যাপ্তি সম্পর্কে ধারণা ও বোধের অভাবে নিজেদের মনগড়া, কল্পনাপ্রসূত ও অনুমান নির্ভর যা খুশি লিখেছেন একই মানসিকতাসম্পন্ন ওই পত্রলেখকদ্বয়— তার প্রতিবাদ না করে পারা যায় না।
, প্রথম পত্রলেখক তো নিজের সৃষ্ট জালেই নিজেই জড়িয়েছেন। ২২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত চিঠিতে তিনি লিখেছেন়— ‘১৯৫৬ সালে আমি ১৪ বছরের কিশোর। আর সেই কিশোরের মনে অনেক কিছু থাকার কথা।’ আবার তিনিই ৬ অক্টোবর লিখছেন— ‘ধরে নেওয়াই যেতে পারে’ অর্থাৎ যুক্তি-প্রমাণের তোয়াক্কা না করে তথ্যের নামে কিছু অনুমান নির্ভর কথাবার্তা গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা।
, ধনপতনগরের কাছে মিঠিপুর ও গিরিয়ায় বড়দা একাধিকবার তাঁর দল নিয়ে আলকাপের অনুষ্ঠান করেছেন। কাজেই ধনপতনগর থেকে শুরু করে গিরিয়া পর্যন্ত ওই সব এলাকা তাঁর নখদর্পণে ছিল। ওই সব অঞ্চলের বিভিন্ন মানুষের কথাও তাঁর অজানা ছিল না। এক জন প্রখ্যাত কথাকারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের তফাত তো এখানেই। বড়দার ছিল গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং তিনি ছিলেন স্মৃতিধর মানুষ। তা না হলে সেই কবেকার সমূহ স্মৃতি থেকে তিনি কী করে সাহিত্য সৃষ্টি করতেন? প্রসঙ্গত, বড়দার একটি উপনাসের কথা ও একটি গল্পের কথা জানাই। ‘নীলঘরের নটী’ উপন্যাসটি সার্কাস জীবন নিয়ে লেখা। উপন্যাস পড়ে মনে হয়, লেখক সার্কাস দলে ছিলেন! আবার ‘সীমান্ত থেকে ফেরা’ গল্পটি নেফা ও লাদাখ সীমান্তে ভারত-চিন যুদ্ধের পটভূমিতে লেখা। এক্ষেত্রেও মনে হয় লেখক যেন ওই সীমান্ত যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন! তবে কি ধরে নেওয়া হবে যে, লেখক সার্কাস দলে বা সীমান্ত যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন? বিভিন্ন সার্কাস দেখার অভিজ্ঞতার সঙ্গে কল্পনার রং মিশিয়ে যেমন ‘নীলঘরের নটী’ উপন্যাস, তেমনি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভারত-চিন যুদ্ধ নিয়ে নিয়মিত লেখার উপরে ভিত্তি করেই ‘সীমান্ত থেকে ফেরা’ গল্প। এখানেই গভীর দৃষ্টি সম্পন্ন কথাশিল্পীর কৃতিত্ব। তেমনি আলকাপের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কল্পনার রং মিশিয়ে সিরাজদা সৃষ্টি করেন ‘মায়ামৃদঙ্গ’। এর জন্য ওস্তাদ ঝাঁকসার বাড়িতে বা তাঁর আলকাপ দলে জড়িত থাকার কথা যারা বলেন, তারা ‘ধরে নেওয়াই যেতে পারে’ বলা ছাড়া আর কি-ই বা বলতে পারেন!
, ধনপতনগর অঞ্চল ছাড়াও জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ওই সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করেন। পত্রলেখক জানেন। তা সত্ত্বেও তিনি মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কল্পনাপ্রসূত তথ্যকে বার বার প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন! তাঁর জানা নেই, ‘মায়ামৃদঙ্গ’ উপন্যাসের দ্বিতীয় সংস্করণ গত ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
, ওই পত্রলেখকের ‘আলকাপ প্রিয়জনগণ’ সৌভাগ্যবশত সকলেই আমার পরিচিত মানুষ। তবে তাঁরা কবে কোন অনুষ্ঠানে মিলিত হয়ে ঝাঁকসাকে ‘আলকাপ সম্রাট’ উপাধি প্রদান করেছেন জানালে বাধিত হব। তবে আমি জানি, জঙ্গিপুরের কুণালকান্তি দে ১৯৮৪ সালে ঝাঁকসার নামের আগে ‘আলকাপ সম্রাট’ বিশেষণটি প্রয়োগ করে ঝাঁকসা সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন তার সম্পাদিত ‘লিপিকা’ পত্রিকায়। স্নেহভাজন কুণালই তার আগে ১৯৮০ সালে ‘আলকাপের শতবর্ষে ঝাঁকসু’ নামে একটি তথ্যবহুল প্রবন্ধ ‘পশ্চিমবঙ্গ’ পত্রিকায় লেখেন। তাহলে কুণালকান্তি দে ‘আলকাপ প্রিয়জনগণ’ হিসেবে গণ্য হলেন না কেন?
, বড়দার আলকাপ জীবন ৬/৭ বছর হলেও ওই অভিজ্ঞতায় তিনি যা করেছেন, নিশ্চয়ই পরবর্তী কালে তার মূল্যায়ন হবে। তবে এটা জানানো প্রয়োজন যে, মানের দিক থেকে বড়দার মত কোনও ওস্তাদই আলকাপকে এতটা উন্নীত করতে পারেননি। বড়দা তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে আলকাপকে উন্নত করার প্রয়াসী হন। গান, ছড়া, ‘কাপ’, কবিয়ালির মধ্যে দিয়েই সেই দায়বদ্ধতাকে প্রতিষ্ঠিতও করেন তিনি। আলকাপ ছেড়ে দেওয়ার পরেও কেবল মুর্শিদাবাদ নয়, বীরভূম জেলার বিভিন্ন আলকাপ দলে বড়দার নামে ‘জয়ধ্বনি’ অর্থাৎ ‘জয় জয় সিরাজ ওস্তাদ কি জয়’ বলা হত। এছাড়া ওই সব দলে বড়দার পূর্বের রচিত গান, দ্বৈত গান, ছড়া ইত্যাদি গাওয়ার পাশাপাশি তাঁর রচিত ‘কাপ’ অভিনীত হতে আমি দেখেছি।
, বড়দা প্রথম এবং সর্বপ্রথম কলকাতার পত্র-পত্রিকায় একের পর এক প্রবন্ধ ও আলোচনা লিখে আলকাপের সঠিক ও যথাযথ বৈশিষ্ট্য নিরূপণ ও মূল্যায়নে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন ষাটের দশকে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ওস্তাদ সম্পর্কেও বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন। বিভিন্ন ওস্তাদের আলকাপ দলের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে প্রতিযোগিতামূলক পাল্লা অনুষ্ঠিত হলেও অগ্রজ ওস্তাদ হিসেবে সকলের সঙ্গেই বড়দার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। আর তার ফলেই ‘মায়ামৃদঙ্গ’ সৃষ্টি তাঁর পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। একথা কোনও ভাবেই অস্বীকার করার নয় যে, ১৯৭২ সালে ‘মায়ামৃদঙ্গ’ প্রকাশের পরেই পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত সমাজ আলকাপ ও ওস্তাদ ঝাঁকসার কথা জানতে পারেন। তার পরেই ওস্তাদ ঝাঁকসার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন— একথাও সত্যি। তবে একথাও সত্যি যে, এর পরেই জেলার কিছু স্বার্থান্বেষী শিক্ষিত মানুষ ওস্তাদ ঝাঁকসা ও আলকাপ নিয়ে মেতে ওঠেন। আবার কেউ ওস্তাদ ঝাঁকসাকে ভাঙিয়ে এবং পরমাত্মীয় হিসেবে তুলে ধরে আখের গুছিয়ে নিতে চেয়ে রাতারাতি ঝাঁকসা দরদী হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ১৯৭২ সালের আগে তাঁদের কলম বা লেখনী কোথায় ছিল?
, ষাটের দশকের শেষের দিকে ওস্তাদ ঝাঁকসা আলকাপ-এর আঙ্গিক, প্রয়োগভঙ্গি ও রীতি প্রকরণের পরিবর্তন ঘটিয়ে ‘পঞ্চরস’-এর সৃষ্টি করেন এবং সরাসরি মহিলা শিল্পীদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে আলকাপের বিলুপ্তি ঘটান। তাহলে দ্বিতীয় পত্রলেখকের কথা অনুযায়ী ‘ঝাঁকসু আমৃত্যু চরম দারিদ্রের মধ্যেও এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন’, তা সঠিক নয়। আলকাপে কোনও দিনই মহিলা শিল্পী ছিলেন না। ওই পত্রলেখক আলকাপের সঙ্গে পঞ্চরসকে গুলিয়ে ফেলেছেন। ‘পঞ্চরস’কে যিনি ‘আলকাপ’ বলে গুলিয়ে ফেলেন, তাঁদের বোধ নিয়েও সংশয় জাগে। সর্বশেষে, ওস্তাদ ঝাঁকসার ‘চরম দারিদ্রের’ দিনে ঝাঁকসা দরদীরা কোথায় ছিলেন?
শিল্পের প্রতি মূল্যবোধ
গত এক মাস ব্যক্তিগত গবেষণার কারণে মুর্শিদাবাদ, মালদহ অবস্থান কালে ‘ডাকঘর’ বিভাগের চিঠি পড়ার সুযোগ হয়। ভাল লাগল সাহিত্যিক মুস্তাফা সিরাজের আর এক অস্তিত্বকেও যে সমান গুরুত্বের সঙ্গে এ ভাবে সম্মান জানানো হচ্ছে। বছর দুই আগে সৌভাগ্য হয়েছিল ওই মানুষটির সঙ্গে আলকাপ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার। অবাক হয়েছিলাম, মাত্র ৬ বছরের অভিজ্ঞতা প্রতি রাতে স্বপ্নে তাঁকে আনন্দ দেয়। পরবর্তী অনেক কিছু ভেবেছেন তত্ত্বের আলোকে, ভাবনার নিরিখে। দীর্ঘ আলোচনায় কোনও ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমালোচনা ছিল না— আশ্চর্য হয়েছিলাম। শিল্পী ঝাঁকসাকে সম্মান করতেন বুঝতে পেরেছিলাম। তাহলে ধরে নেওয়া যেতেই পারে শিল্পের প্রতি মূল্যবোধ একজন শিল্পীর যতোটা থাকা উচিত— তাঁর ছিল। তাই পরবর্তী জীবনে তিনি সাহিত্যচর্চায় মনোযোগী হলেও আলকাপের প্রতি তাঁর যথেষ্ট আনুগত্য ছিল। তাঁর সেই প্রতিভা ছিল বলেই হয়তো এ ভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। শুধুই ‘মায়ামৃদঙ্গ’ কেন বিভিন্ন প্রবন্ধে, মূল্যবান দীর্ঘ বক্তৃতার লিখিত বয়ানে তিনি আলকাপকে যথেষ্ট মর্যাদার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। ‘পঞ্চরসের’ স্রষ্টা ওস্তাদ ঝাঁকসা তিনিই বলেছেন। আর একটি কথা, কোনও ভাষার শিক্ষাগ্রহণে ব্যক্তি ছেড়ে সমাজই মূল ক্ষেত্র। তাই চাঁই ভাষা শিক্ষার জন্য তাঁকে কোনও ব্যক্তির উপর নির্ভর করতে হয়েছিল, এও যেন ঠিক গ্রহণযোগ্য হল না। আর নিজেকে প্রথম জীবনে ভবঘুরে বাউণ্ডুলে বলা মানেই তিনি যাযাবর— এও মেনে নিতে হবে? ব্যক্তিগত একাধিক দীর্ঘ আলাপচারিতায় কখনও জানতে পারিনি কখনও তিনি ওস্তাদ ঝাঁকসার বাড়িতে থাকতেন। এও ধরে নেব? খানিকটা ছোটবেলার বাঁশের অঙ্কের ‘ধরিলাম’ গোছের হয়ে যাচ্ছে না? যেখানে একটা মানুষ ছ’বছরের মতো দামী সময়কে বলছেন “ষাট হাজার ঘণ্টা ধরে যেন টানা ঘুমের মধ্যে একবারও পাশ ফিরে শুইনি’— তিনি কোনও বাঁধাধরা মন্তব্যের মধ্যে পড়েন না। কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি নয়, সামগ্রিক দৃষ্টিতে অনুরোধ একটি মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাঁকে নিয়ে অযথা কোনও আরোপিত ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত না করাই কাম্য। ওস্তাদ ঝাঁকসা, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এঁরা আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। শিল্পের ঐতিহ্য ও মর্যাদায় যেমন প্রয়োজন শিল্পীর তেমনই প্রয়োজন একজন শিল্পবোধ সমন্বিত তাত্ত্বিকের। ওই দুইয়ের মেলবন্ধনেই তো শিল্পের আজীবন পথ চলা। প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে থাকবে তার বহমানতা। আশা করব প্রত্যেকেই সেই সৃষ্টি পথেই নিজেদের আবদ্ধ রাখবেন। তাহলেই হবে এরকম একটি মূল্যবান শিল্পের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.