|
|
|
|
|
|
|
বঙ্গে বাণিজ্য |
পরিবর্তনটাই ‘সন্দেশ’
গৌতম চক্রবর্তী |
|
সবুরে নকুড় ফলে! উনিশ শতকের ঐতিহ্যে শুরু, কিন্তু বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে নকুড়ের সন্দেশ হয়ে উঠেছে সর্বভারতীয় ব্র্যান্ড। তখন ফেলুদার বাড়ি আসার সময় লালমোহনবাবু প্রায়ই নকুড়ের সন্দেশ নিয়ে আসতেন। হাল আমলেও বিরাম নেই। মাস কয়েক আগে মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টনকে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ১০০টি কাঁচাগোল্লা ও ১০০টি পারিজাত সন্দেশ উপহার দিয়েছিলেন, তা গিয়েছিল উত্তর কলকাতার নকুড়ের দোকান থেকেই। কলকাতা নাইটরাইডার্স চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে ইডেন গার্ডেন্সে রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ‘টিম শাহরুখ’ সর দিয়ে মোড়া ৩৪ কেজির যে ‘সন্দেশ কেক’ কেটেছিল, তারও স্রষ্টা নকুড়। মায় অ্যাশ-অভিষেকের বিয়েতে জয়া বচ্চন চকোলেট সন্দেশ, পারিজাত ও মৌসুমী সন্দেশ পাঠানোর বরাত দিয়েছিলেন এই নকুড়কেই। সংস্কৃতির ইতিহাসে যা ঘটেনি, ব্যবসার ইতিহাসে সেটিই ঘটিয়ে দিল উত্তর কলকাতার ‘গিরিশচন্দ্র দে ও নকুড়চন্দ্র নন্দী।’ উনিশ শতকের ‘নবজাগরণ’, ‘স্বদেশিয়ানা’ ইত্যদি বাঙালি ব্র্যান্ড সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ক্রমেই ম্লান ও হতমান হয়েছে, আর নকুড়ের সন্দেশ আলো ছড়িয়েছে।
এই আলো টিকিয়ে রাখার পিছনে আশা দে নামে এক ভদ্রমহিলার ভূমিকা কম নয়। তিনি নকুড়চন্দ্রের পুত্র অনুকূল নন্দীর কন্যা। অনুকূল নন্দীর মৃত্যুর পরে দোকানের ভার নেন তাঁর পুত্র পরেশ নন্দী। কিন্তু মাত্র ৪১ বছর বয়সে চার নাবালক ছেলেকে রেখে আচমকা তিনি মারা যান।
সেটি ১৯৬৭ সালের ঘটনা। বিপদ তখন একা আসেনি। পরেশবাবুর মৃত্যুর পরে অন্য ঘটনা। মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন ছানার ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। দোকানে দেড় বছর ধরে তালা। প্রয়াত পরেশবাবুর স্ত্রী ভীম নাগদের বাড়ির মেয়ে। তাঁরা বিধবা কন্যাকে পরামর্শ দিলেন, দোকান রেখে লাভ নেই। |
|
তখনই রুখে দাঁড়ালেন পরেশবাবুর বোন আশা দে। তাঁর স্বামীর সর্বক্ষণ টাকার খাঁই। ফলে তিনি বাপের বাড়িতেই থাকেন। পারিবারিক দোকান বিক্রি হয়ে যাবে, অত্যাচারী স্বামীর হাত থেকে বাঁচিয়ে কন্যাকে তা হলে কী ভাবে পাত্রস্থ করা যাবে? আশাদেবীর জেদেই দোকান বন্ধ হল না। পুরনো কর্মচারীরাও এগিয়ে এলেন দোকানকে ভীম নাগের গ্রাস থেকে বাঁচাতে। “পিসি এবং ওই কর্মীরা না থাকলে দোকানটা থাকত না,” বলছিলেন আশা দে-র সে দিনের নাবালক ভাইপো, আজকের নকুড়ের অন্যতম কর্ণধার প্রশান্ত নন্দী। পারিবারিক রাজনীতি, ব্যবসায়িক আগ্রাসন এবং পৈতৃক সম্পত্তি বাঁচাতে এক মহিলার লড়াই সব একাকার হয়ে আছে নকুড়ের ইতিহাসে।
সত্তর দশকে বাঙালির ব্যবসায় অন্য বিপদও এসেছিল। রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে ‘গিরিশচন্দ্র দে ও নকুড়চন্দ্র নন্দী’র দোকানে এখনও বসে খাওয়ার বন্দোবস্ত নেই। মিষ্টি বিক্রির কাউন্টার সবুজরঙা লোহার গরাদে ঘেরা। “নকশাল আমলে গরাদ বসানো হয়েছিল। তখন দোকানে ডাকাতির চেষ্টা হত,” বললেন প্রশান্তবাবু।
কাউন্টারের পিছনেই ওয়র্কশপ। দেওয়ালে চারটি ঢাউস জগন্নাথের পট, অদূরে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা হচ্ছে ছানা। সন্দেশ তৈরির প্রথম পর্ব এখানেই। আলাদা থালায় রাখা হচ্ছে ৫ কেজি ও আড়াই কেজি করে ছানা। বড় কাঠের বারকোষে ছানায় পাক দিচ্ছেন দোকানের তিরিশ বছরের কর্মী, বিহারের শেখপুরা জেলার উতীশ মণ্ডল। ভাল জাতের ছানা এবং চিনি ছাড়া ভাল সন্দেশ হবে না।
এই ছানা তৈরির জন্য রোজ সকাল, বিকেল দু’বেলা হাজার লিটারেরও বেশি দুধ আসে নকুড়ের রান্নাঘরে। চার জন সরবরাহ করেন দুধ, দু’জন চিনি। বার্নারের আগুনে ঘুরে যাচ্ছে বিশাল এক বালতি। প্রায় ১০০ লিটার দুধ জ্বাল দেওয়া যায় সেখানে। ছড়িয়েছিটিয়ে আরও চারটি উনুন। কোথাও দুধ গরম হচ্ছে, কোথাও বা বাটারস্কচ, স্ট্রবেরি, চকোলেট মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে হরেক রকম সর। গড়ে উঠবে সন্দেশ। এক পাশে নারকেল কোরার মেশিন। ২২ জন কর্মীর তুমুল ব্যস্ততা। কেউ গরম দুধে ছানার জল মিশিয়ে ছানা তৈরি করছেন, কেউ বা মিহি কাপড়ে ছেঁকে সেই ছানা পাক করছেন। উতীশ বলছিলেন, “সকাল ৭টা থেকে ১২টা, এবং বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা অবধি এ রকমই তাঁদের রোজনামচা।” |
|
ব্যবসার হিসেব, স্ট্র্যাটেজিক কলাকৌশল কিছুই ফাঁস করতে নারাজ প্রশান্তবাবু। সাধ্যসাধনায় জানা গেল, মোট দুধের ২৫ শতাংশ ছানা। মানে, ১০০ লিটার দুধ ছিন্ন করে বড় জোর ২৫ কেজি ছানা। দুধের পরিমাণ এবং ৩৫০ টাকা কেজি দরে ছানা হিসেব করলে দোকানের টার্ন ওভার ১ লাখ টাকারও বেশি। “অত অঙ্কে দরকার কী? ভাল সন্দেশের জন্য ভাল উপকরণ এবং ভালো কারিগর দুটিই জরুরি,” বললেন প্রশান্তবাবু। তার পরে তৃপ্তির হাসি হাসলেন, “তবে ব্যবসার ভল্যুম গত ১০ বছরে প্রচুর বেড়েছে।”
কিন্তু, ডাক্তারেরা তো বলেন, ভারত দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে বিশ্বের এক নম্বর ডায়াবেটিক দেশ হওয়ার দিকে। ডায়াবেটিস বাড়া সত্ত্বেও কী ভাবে বিক্রি বাড়ছে নকুড়ের? জানা গেল, নকুড়ের সন্দেশ এখন আর শুধু বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। “অবাঙালিরা প্রচুর মিষ্টি কেনেন। চকোলেট সন্দেশের বিক্রিই বেড়ে গিয়েছে দু’শো গুণ,” বললেন প্রশান্তবাবু। একুশ শতকে নকুড়ের ব্যবসায়িক সাফল্যের অন্যতম কারণ সেখানেই। সন্দেশকে বাঙালিয়ানার গণ্ডি থেকে বের করে আনা।
নতুন এক্সপেরিমেন্টই এই গণ্ডি ভেঙেছে। এক দিকে চকোলেট, স্ট্রবেরি কিংবা ব্ল্যাক কারেন্ট দিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন সন্দেশ। কখনও পাওয়া যাচ্ছে পুরু আমের পাল্পকে কেন্দ্র করে ‘আম্রপালী’, কখনও বাটারস্কচ, চকোলেট, স্ট্রবেরিকে পরপর তিন ধাপে সাজিয়ে তৈরি হয়েছে ‘থ্রি স্টার’ সন্দেশ। নতুন প্রজন্মের কাছে এইগুলি অন্যতম আকর্ষণ। ‘‘বছর বছর নতুন ফ্যাশনের শাড়ি তৈরি হয় না? তা হলে সন্দেশের বেলায় গেল গেল রব কেন?” গল্পে গল্পে প্রশ্ন ছুড়লেন প্রশান্তবাবু।
নতুন সন্দেশ আছে, আছে সন্দেশের পুরভরা মালাই রোল। এবং তার সঙ্গে গোলাপী পেড়া, জলভরার মতো ট্র্যাডিশনাল সন্দেশ। আছে শীতকালের স্বাদু গন্ধে ভরা নলেন গুড়ের সন্দেশ। বংশানুক্রমিক সাপ্লায়ারেরা এখনও নদিয়ার হাঁসখালি থেকে নিয়ে আসেন গুড়। এবং নলেন গুড়ের সেই সন্দেশ আজও নকুড়ের অন্যতম ব্র্যান্ড ইকুইটি। “আগে সিজনের ছয় মাস যা গুড় কিনতাম, এখন এক সপ্তাহে সেই গুড় কিনতে হয়,” বললেন প্রশান্তবাবু। |
|
ইতিহাসের খাতিরে রং চটা টিনের একটি পুরনো বোর্ড দেখালেন প্রশান্তবাবু। বোর্ডের এক পাশে আবছা অক্ষর আজও পড়া যায়, সরেস চন্দ্রপুলি। নারকেলের পুর দিয়ে হত চন্দ্রপুলি। এক বার দেখা গেল, নারকেল কোরা অনেকটা বেশি হয়ে গিয়েছে। ফেলে দিতে হবে? প্রশান্তবাবুর বুদ্ধিতে ওই পুর থেকে তৈরি হল মৌসুমী সন্দেশ। শুনলাম, তিরিশ বছর আগে এই দোকানে বড়জোর ৬ রকম সন্দেশ থাকত, এখন প্রায় ৬০ রকম। তিরিশ বছর আগে সে দিনও স্পঞ্জ রসগোল্লা, ল্যাংচা বানানোর উৎসাহ পেতেন না প্রশান্তবাবুরা, আজও তথৈবচ।
আর সেখানেই ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি। সন্দেশই নকুড়ের ‘কোর কম্পিটেন্স’, সেই দক্ষতাতেই তাঁরা শান দিয়েছেন, এনেছেন হরেক বৈচিত্র। আর এই ‘কোর কম্পিটেন্স’ই প্রশান্তবাবুদের করে তুলেছে আত্মবিশ্বাসী। নকুড়ের সন্দেশের কি দাম বেশি নয়? একটা আম্রপালী বা স্ট্রবেরি সন্দেশ কিনতেই তো কুড়ি টাকা খসাতে হয়! “ক্রেতারা এখন খুব সচেতন। ‘ভ্যালু ফর মানি’ না পেলে কি তাঁরা আমাদের দোকানে ভিড় জমাতেন?” পাল্টা প্রশ্ন প্রশান্তবাবুর।
পাঁচ পুরুষের ব্যবসা। তবু আত্মতুষ্ট না হয়ে প্রতিনিয়ত কোর কম্পিটেন্স বাড়িয়ে যাওয়া...এটাই নকুড়ের গোপন, ব্যবসায়িক সন্দেশ!
|
ছবি: শুভেন্দু চাকী |
|
|
|
|
|