জেলের ভিতর থেকে মোবাইল ফোনে কথা বলার প্রবণতা কমাতে বন্দিদের জন্য পাবলিক ফোন
বুথ বসিয়েছিল কারা দফতর। কিন্তু বছর ঘুরতে
না-ঘুরতেই দেখা গেল, সার্ভিস প্রোভাইডারের প্রাপ্য ১১ লক্ষ টাকা বাকি পড়ে গিয়েছে। বন্দিরা ফোনে কথা বলতে উৎসাহই দেখায়নি। টাকা না-পেয়ে সার্ভিস প্রোভাইডার সংস্থা কলকাতার তিনটি জেলের মোট ১৭টি ফোন-বুথ বন্ধ করে দিয়েছে।
তা হলে কি বন্দিদের ফোনে কথা বলার প্রবণতা
কমে গেল? মোটেই তা নয়। কারা দফতর তদন্তে
দেখেছে, মোবাইল ফোনের ব্যবহার রুখতে বুথের ব্যবস্থা হয়েছিল। অথচ মোবাইল ফোনে ছেয়ে গিয়েছে প্রায় সব জেলই। এক শ্রেণির জেলকর্মীর হাত ঘুরে মোবাইল পৌঁছে যাচ্ছে বিভিন্ন সেলে। ফলে বন্দিরা কেউ জেলের বুথ থেকে ফোন করছে না।
বন্দিরা বুথ ব্যবহার করছে না কেন?
কারা দফতর সূত্রের খবর, ওই সব বুথে ভয়েস রেকর্ডিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। আগের থেকে জেল-কর্তৃপক্ষের কাছে তিনটি নির্দিষ্ট নম্বর দিয়ে রাখতে হয়। সেই তিনটি ছাড়া বাইরের অন্য কোনও নম্বরে ফোন করা যায় না। তার উপরে রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা থাকায় কার সঙ্গে কী কথা হল, তার প্রমাণ থেকে যায়। অথচ টাকা ফেললেই সেলে চলে আসে মোবাইল। তাতে সব রকম গোপনতাও রক্ষা করা যায়।
তাই ফোন-বুথ ব্রাত্য! এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গোপনতা
রক্ষার অধিকারের প্রশ্নটিও ওঠে। তবে কারাকর্তাদের একাংশের বক্তব্য, বন্দিজীবনে ব্যক্তির গোপনতা
রক্ষার বিষয়টি মুক্ত জীবনের মতো অবাধ নয়। নিরাপত্তার কারণেই জেলের ফোন-বুথে ভয়েস রেকর্ডিংয়ের বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
তদন্তে দেখা গিয়েছে, সেলে অবাধে মোবাইল পৌঁছে যাওয়ায় জেলে বসেই অনেক কয়েদি তোলাবাজি চালাচ্ছে। খুন, অপহরণ-সহ নানা ধরনের অপরাধের ছক কষছে। সেই জন্য কয়েদিদের মোবাইলে কথা বলার প্রবণতা কমাতে বাম আমলে জেলে ফোন-বুথ খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে দমদম সেন্ট্রাল জেলে পাঁচটি বুথ বসে। রাজ্যে পালাবদলের পরে, গত বছর আলিপুর সেন্ট্রাল জেল এবং প্রেসিডেন্সি জেলে যথাক্রমে সাতটি এবং পাঁচটি বুথ খোলা হয়। সরকারি খরচে ওই সব বুথ খুলেছিল একটি বেসরকারি মোবাইল পরিষেবা সংস্থা। ঠিক হয়েছিল, প্রতি মাসে ওই মোবাইল সংস্থাকে ৫০ হাজার টাকা দেবে সংশ্লিষ্ট জেল। এবং সেই টাকা আসবে বন্দিদের দেওয়া অর্থ থেকেই।
কিন্তু এই ব্যবস্থা সফল হল না কেন?
কারা দফতর সূত্রের খবর, ফোন করলে কথাবার্তা রেকর্ড করা হচ্ছে জেনে বেশির ভাগ বন্দিই বুথ ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছে। বন্দিদের প্রশ্ন, কারা দফতর ব্যক্তিগত কথাবার্তা রেকর্ড করবে কেন? কারাকর্তাদের একাংশের বক্তব্য, নিরাপত্তার স্বার্থেই রেকর্ডিংয়ের এই ব্যবস্থা। কিন্তু বন্দিরা বুথের ব্যবহার কমিয়ে দেওয়ায় ফোন বাবদ কারা দফতরের আয় কমেছে। ফলে মোবাইল সংস্থাটি চুক্তিমতো মাসিক টাকা পায়নি। তিনটি জেল মিলিয়ে ১১ লক্ষ টাকা বাকি পড়ে যাওয়ায় ওই সংস্থা বুথ বন্ধ করে দিয়েছে।
কারা দফতরের এক কর্তা বলেন, “প্রাথমিক সমীক্ষায় হিসেব করা হয়েছিল, বিচারাধীন ও দণ্ডিত মিলিয়ে সেন্ট্রাল জেলগুলির প্রায় দু’হাজার বন্দির মধ্যে অন্তত এক হাজার জন বুথে কথা বলার কুপন কিনবে।” ওই কর্তা জানান, প্রত্যেক বন্দিকে সপ্তাহে দু’দিন পাঁচ মিনিট করে কথা
বলার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ মাসে মোট ৪০ মিনিট। ওই ৪০ মিনিট কথা বলার জন্য নেওয়া হত ৫০ টাকা। এক হাজার বন্দি ৫০ টাকা করে দিলে মোবাইল সংস্থার মাসিক পাওনা ৫০ হাজার টাকা উঠে আসত। কিন্তু যা ভাবা গিয়েছিল, তা হয়নি। ফলে ফোন-বুথ প্রকল্পই মুখ থুবড়ে পড়েছে।
কারা দফতর এখন বন্দিদের নতুন ‘অফার’ দেওয়ার কথা ভাবছে। সপ্তাহে দু’দিনের জায়গায় পাঁচ দিন কথা বলা যাবে ১০ মিনিট করে। অর্থাৎ সারা মাসে কথা বলা যাবে মোট ২০০ মিনিট। তার বদলে বন্দিদের দিতে হবে ১০০ টাকা। আগে জানিয়ে দেওয়া মাত্র তিনটি নম্বরেই ফোন করতে পারত কয়েদিরা। এখন তারা পাঁচটি নম্বরে ফোন করতে পারবে। তবে ভয়েস রেকর্ডিং চালু থাকবে। তবে সেলে মোবাইল পৌঁছনো বন্ধ করতে না-পারলে এই ‘অফার’ কতটা জনপ্রিয় হবে, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন জেল-কর্তারা। স্বরাষ্ট্র দফতরের কাছে নতুন ব্যবস্থার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে বলে জানান আইজি (কারা) রণধীর কুমার। সেলে মোবাইল বন্ধ করা যাচ্ছে না কেন, তার যথাযথ ব্যাখ্যা না-পেলে ওই প্রস্তাবের ফাইল ছাড়া হবে না বলে স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর। |