ধামসার বাজনা শুনে হাঁটা থামিয়ে অনেকেই বাজনদারদের ঘিরে ধরছেন। ঠিক তখনই মুখোশ পড়ে ছৌশিল্পীরা আসরে ঢুকে পড়ে নাচ শুরু করছেন। পাশ থেকে তাঁদের সঙ্গীরা জিনিসপত্র কিনে ঠকলে কী করা উচিত, সেই কথা সুর করে শোনাচ্ছেন।
এ ভাবেই ছৌনাচকে হাতিয়ার করে সচেতনতার প্রচার চালাচ্ছে পুরুলিয়া জেলা ক্রেতা সুরক্ষা দফতর। কোথাও আবার পথ নাটিকা, কোথাও কথা-বলা পুতুল, বাউলগান বা ঝুমুরদলেরও শিল্পীদেরও প্রচারে নামানো হয়েছে। পুরুলিয়া জেলা জুড়েই লোক সংস্কৃতির মোড়কে প্রচার চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ক্রেতা সুরক্ষা দফতরের আধিকারিকরা। তাঁদের দাবি, ক্রেতা সচেতনতায় এ ধরনের প্রচারে সুফলও মিলছে। প্রচার মাধ্যমের বিভিন্ন দিক থাকা সত্ত্বেও এখনও পুরুলিয়াতে লোক সংস্কৃতি যে ভাবে মানুষকে আকৃষ্ট করে, তা অন্য কোনও মাধ্যমে সম্ভব নয় বলে তাঁরা মনে করছেন। দফতরের পুরুলিয়া জেলার সহ-অধিকর্তা গঙ্গাধর চট্টোপাধ্যায় বলেন, “উপভোক্তাদের বেশির ভাগই নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। কিছু কেনার পর ঠকে গেলে কী করবেন, তা অনেক উপভোক্তার কাছে স্পষ্ট নয়। তাই পুরুলিয়ার গ্রামাঞ্চলে হাটে-মাঠে-বাজারে লোক সংস্কৃতির মোড়কে ক্রেতা সুরক্ষা সংক্রান্ত বার্তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছি।” |
মানবাজার থানার মেটালা ছৌ দলের শিল্পী শচীন্দ্রনাথ মাহাতো বলেন, “কোনও জায়গায় গিয়ে আমরা প্রথমে ধামসা বাজানো শুরু করছি। তা শুনে লোক জড়ো হতেই আমরা প্রচারের কাজ শুরু করে দিচ্ছি। ক্রেতাদের সুরক্ষিত করতে সরকার কী কী সুবিধা দিয়েছেন, প্রতারিত হলেই বা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কোথায় যেতে হবে, সে সব কথাই আমরা লোকেদের জানাচ্ছি।” পালার রচয়িতা ও নির্দেশক মনোরঞ্জন মাহাতো বলেন, “সমস্ত বিষয় খুব সহজ-সরল ভাবে দর্শকদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।” ঘটনা হল, যে গাড়ি ভাড়া নিয়ে এই ছৌনাচের দল বিভিন্ন এলাকায় প্রচারে যাচ্ছে, সেই গাড়ি কেনা নিয়েও বিভ্রাটে পড়তে হয়েছিল গাড়ির মালিককে। গাড়ির ঋণ মিটিয়ে দেওয়ার পরেও সেই ঋণদানকারী সংস্থা গাড়ির মালিককে জানিয়েছিল মোটা টাকার ঋণ বাকি রয়েছে। পরে ক্রেতা দফতরের দ্বারস্থ হয়ে তিনি সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পান। গাড়ির মালিক এখন অসুস্থ। তাঁর হয়ে সে কথা শোনালেন মনোরঞ্জনবাবু।
এই প্রচার দেখে পুঞ্চা থানার চাঁদড়া গ্রামের আদিত্য সিং বলেন, “এ ধরনের একটা দফতর রয়েছে জানতাম না।” স্থানীয় বাগদা গ্রামের তপন দত্তের মতে, “ছৌনাচের পালার মাধ্যমে পরিবেশন করায় আমাদের মত সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারছি।” কমলপুর গ্রামের নবীন বাউরির অভিজ্ঞতা, “দোকান থেকে জিনিস কেনার পর দাম অথবা মান সম্পর্কে অভিযোগ করলে দোকানদার গুরুত্ব দিতেন না। ফলে ঠকে গিয়েছি বুঝেও চুপ করে থাকতে হত। এ বার তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।” দফতরের আধিকারিকরা জানান, জিনিস কেনা অথবা পরিষেবা সংক্রান্ত অভিযোগ পাওয়ার পরে অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত অথবা সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনায় বসা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আলোচনাতেই অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়ে যায়। ছাত্র-জীবন থেকে যাতে ক্রেতার অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা হয়, সে জন্য জেলার ২০টি স্কুলে পড়ুয়াদের নিয়ে ফোরাম গঠন করা হয়েছে। জেলার সহকারি অধিকর্তা জানান, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ক্রেতা সুরক্ষা বিষয়ক ৩৭টি অভিযোগ তাঁদের কাছে নথিভুক্ত হয়েছে। তার মধ্যে ৬০ শতাংশ অভিযোগ গ্রামাঞ্চল থেকে পেয়েছেন। প্রচারে যে ক্রেতা সচেতনতার গতি বেড়েছে, এ যেন তারই প্রতিফলন। |