বছর ঘুরে গেলেও হুগলির বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ-কর্তা সুপ্তেন্দু দত্ত হত্যা-মামলার চার্জশিট দিতে পারেনি সিআইডি।
ঘটনার যথাযথ তদন্ত এবং দোষীদের শাস্তি চেয়ে ইতিমধ্যে নিহতের স্ত্রী মৌসুমিদেবী মহাকরণ এবং ভবানীভবনে বারবার ঘুরেছেন। কিন্তু কিছু আশ্বাস মেলা ছাড়া আর কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলে তাঁর অভিযোগ। এখনও আতঙ্ক কমেনি ওই পরিবারের। নিরাপত্তার দাবি জানানোয় জেলা পুলিশ মৌসুমিদেবীকে অবশ্য দেহরক্ষী দিয়েছে।
সিআইডি-র ডিআইজি (অপারেশন) শঙ্কর চক্রবর্তীর দাবি, “তদন্তের কাজ প্রায় শেষ। খুব শীঘ্রই আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে।” কিন্তু কেন সুপ্তেন্দুবাবুকে খুন করা হয়েছিল, সে ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি শঙ্করবাবু। তিনি বলেন, “এখন এ নিয়ে কিছু বলা যাবে না।” এক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরে মৌসুমিদেবী বলেন, “আমি হতাশ এবং আতঙ্কিত। স্বামী খুন হওয়ার পর থেকে সর্বত্র দৌড়ে বেড়াচ্ছি। শুধু আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। এখনও জানতে পারলাম না কেন স্বামীকে খুন করা হল।”
গত বছর ৮ সেপ্টেম্বর রাত দেড়টা নাগাদ বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ের উত্তর বাদরা বাসস্ট্যান্ডের কাছে নিজের গাড়ি থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয় চুঁচুড়ার বাসিন্দা সুপ্তেন্দু দত্তের দেহ। খুন হন তাঁর গাড়ি-চালক সুশান্ত ঘোষালও। সে সময়ে প্রাথমিক তদন্তে জেলা পুলিশ জানতে পারে, কলেজের হিসাবরক্ষক সংস্থার সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না সুপ্তেন্দুবাবুর। সেই কারণে ওই সংস্থার কর্মীকে নিয়েই নতুন হিসাবরক্ষকের খোঁজে সে দিন কলকাতায় আসেন সুপ্তেন্দু। রাতে ওই কর্মীকে নামিয়ে বাড়ি ফেরার পথে খুন হন সুপ্তেন্দুবাবু ও তাঁর গাড়ির চালক। |
মেয়েকে কোলে নিয়ে মৌসুমিদেবী। ছবি: তাপস ঘোষ |
এর পরে এই এক বছরে গ্রেফতার করা হয় মোট পাঁচ জনকে। তাদের মধ্যে সুপ্তেন্দুবাবুর হিসাবরক্ষক সংস্থার কর্মী অসিত রায়ও রয়েছেন। তিনি পরে জামিন পান। সেই সময়ে পুলিশের দাবি ছিল, অসিতবাবুর মোবাইল থেকে বেশ কিছু তথ্য মেলে। তাঁর বক্তব্যেও অসঙ্গতি ছিল। অসিতবাবু জানিয়েছিলেন, ওই দিন রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ সুপ্তেন্দুবাবু বাড়ির কাছে তাঁকে নামিয়ে দেন। কিন্তু ওই সময়ে অসিতবাবুর মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন ছিল গিরিশ পার্ক এবং সুপ্তেন্দুবাবুর শ্যামবাজার এলাকায়। সে সময়ে অসিতবাবু আসলে কোথায় ছিলেন এবং কখন বাড়ি ফিরেছিলেন তা নিয়ে ধন্দে ছিলেন জেলা পুলিশের কর্তারা।
তদন্তকারীরা জানিয়েছিলেন, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে খুন করা হয়েছিল সুপ্তেন্দুবাবুকে। খুনের ধরন দেখে দমদমের দুষ্কৃতী রাজা দত্তের উপরে সন্দেহ গিয়ে পড়ে পুলিশের। ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। কেননা, সুপ্তেন্দুবাবু খুন হওয়ার বেশ কিছু দিন আগে বেলঘরিয়ার সিসিআর সেতুর নীচে একই ভাবে খুন করা হয়েছিল এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মীকে। সেই ঘটনায় নাম জড়িয়েছিল রাজার।
নিহত সুপ্তেন্দুবাবুর জুতোতে এবং
গাড়ির ভিতরে বালি ও কাদা পেয়েছিল পুলিশ। তদন্তকারীদের ধারণা ছিল, কোনও নির্মীয়মাণ আবাসনে নিয়ে গিয়ে খুন করা
হয় ওই কলেজ-কর্তাকে। উত্তর বাদরা বাসস্টপের কাছেই ওই ঘটনা ঘটে বলে তদন্তে জানতে পারে পুলিশ। কিন্তু এর পরে গোটা বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। পুলিশি তদন্তেও শিথিলতা আসে। মৌসুমিদেবীর আবেদনের ভিত্তিতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তদন্তভার নেয় সিআইডি।
একটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় গত ২৫ জুলাই বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ অরূপ দত্ত ওরফে বান্টি এবং সৈকত দাস ওরফে বুম্বা নামে দু’জনকে গ্রেফতার করে। প্রথম জন এয়ারপোর্ট থানার শরৎ কলোনি এলাকার এবং দ্বিতীয় জন মাইকেলনগরের বাসিন্দা। জেরায় তারা সুপ্তেন্দুবাবুদের খুনের কথা কবুল করে বলে দাবি করে পুলিশ। সিআইডি দু’জনকে নিজেদের হেফাজতে নেয়। ধৃতদের জেরা করে জিমি নামে এক যুবককেও গ্রেফতার করে সিআইডি। খুনে ব্যবহৃত অস্ত্র জিমি সরবরাহ করেছিল বলে সিআইডির দাবি। তবে সেই অস্ত্র সিআইডি উদ্ধার করতে পারেনি। মৌসুমিদেবী কয়েক জনের নামে নির্দিষ্ট তথ্য দিলেও তাঁদের জেরা করা দূরের কথা, সিআইডি অফিসারেরা খোঁজ পর্যন্ত নেননি বলে অভিযোগ। সিআইডি অভিযোগ মানেনি। ওই ঘটনার তদন্তের দায়িত্বে থাকা তৎকালীন জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “সিআইডি সে ভাবে কাউকে জেরা করেছে বলে জানি না। আমরা তদন্ত গুটিয়ে এনেছিলাম। কিন্তু সিআইডি তদন্তভার নেওয়ার পরে আমাদের আর কিছুই করার ছিল না।” |