জাতীয় রাজনীতির দুই বৃহৎ প্রতিদ্বন্দ্বী দল কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টির মধ্যবর্তী পরিসরটিতে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন স্বামী বিবেকানন্দ। কোন দিকটি তাঁহার বেশি নিকটের, ইহাই প্রতিদ্বন্দ্বিতার উপজীব্য। গুজরাতে নরেন্দ্র মোদীর দাবি অনুসারে বিবেকানন্দ কি বিজেপির দলীয় নীতিরই দিগ্দর্শক? নাকি রাজকোট রামকৃষ্ণ মিশনে সশরীরে উপস্থিত হইয়া সনিয়া গাঁধী যাহা পরোক্ষে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করিতেছেন, তাহাই ঠিক, অর্থাৎ রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ঐতিহ্যের সহিত নেহরু-গাঁধী পরিবার তথা কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সংস্কৃতির সম্পর্কই ঘনিষ্ঠতর? ইতিমধ্যে রামকৃষ্ণ মিশন কিন্তু স্পষ্ট করিয়া দিয়াছেন যে জনসংযোগের স্বার্থে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর এই অহৈতুকী বিবেকানন্দ-প্রীতি তাঁহারা ভাল চোখে দেখিতেছেন না। যে কেহই তাঁহাকে শ্রদ্ধা জানাইতে পারেন, কিন্তু বালক-বালিকাদের উদ্বুদ্ধ করিতে ক্রীড়াসামগ্রীর উপর তাঁহার ছবি লাগাইয়া দিবার মধ্যে শ্রদ্ধার প্রকাশ নাই, আছে রাজনৈতিক স্বার্থসন্ধানের চিহ্ন: তাঁহাদের সঙ্গত সমালোচনা। সব মিলাইয়া ঊনবিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতীয়তাবাদী হিন্দু চিন্তক আবারও দেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের ঐতিহ্য-যুদ্ধের লক্ষ্যবিন্দু।
তবে এই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিন্তু প্রকৃত অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নহে, রাজনৈতিক সহচারিতা মাত্র। প্রতিদ্বন্দ্বিতা তো তখনই সম্ভব, যখন প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল দুইটি ভিন্ন ধারা কিংবা আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করে! দুর্ভাগ্যের বিষয়, কংগ্রেস ও বিজেপি বহু ক্ষেত্রেই তাহা করে না। এই বিশেষ ক্ষেত্রটিও তেমন। রামকৃষ্ণ মিশন যথার্থই উপলব্ধি করিয়াছেন, বিবেকানন্দের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এক কথা, আর তাঁহার ঐতিহ্য রাজনীতির বাহক হিসাবে সুবিধা-অনুযায়ী টানিয়া আনা ভিন্ন কথা। এই দিক দিয়া কংগ্রেস ও বিজেপির অবস্থানগত পার্থক্য নাই বলিলেই চলে, কিংবা, থাকিলেও অত্যন্ত স্বল্প। মোদী যাহা খোলাখুলি ঘোষণা করিতেছেন, সনিয়া গাঁধী মিশনের সহিত তাঁহাদের পারিবারিক সংযোগের বিষয়টি সুনিপুণ ভাবে তুলিয়া ধরিয়া সেই একই রাজনীতি-রেখায় চলিতেছেন। তিনি বলিতেই পারেন, তিনি তো দলগত ভাবে এ বিষয়ে অবস্থান লন নাই, কোনও প্রত্যক্ষ কথা বলেন নাই। কিন্তু রাজনীতি কেবল কথিত বা ঘোষিত বস্তু নহে, দৃষ্ট বা অনুভূত বস্তুও বটে। তাঁহার ‘পারিবারিক’ ঐতিহ্যটি পালনের অতি সুনির্বাচিত সময় ও স্থান জনসাধারণের দৃষ্টি ও অনুভূতিতে ধরা পড়িয়াছে বই কী। জনসাধারণ জানেন বিজেপির সহিত সনিয়ার কংগ্রেসের পার্থক্য ঠিক কোথায়। একটি প্রত্যক্ষ, অন্যটি পরোক্ষ। একটি ঘোষিত হিন্দুত্ব, অন্যটি প্রচ্ছন্ন, ‘নরম’ হিন্দুত্ব। কিন্তু ইহা পরিমাণগত পার্থক্য, গুণগত নহে। দুইয়ের মধ্যে নীতি কিংবা অভিমুখের তফাত খুঁজিলে হতাশ হইতে হইবে। ‘জাতীয়’ সংস্কৃতির নামে এই নরম হিন্দুত্ব কংগ্রেস নেতৃত্ব বরাবর পালন করিয়া আসিয়াছে। ইন্দিরা গাঁধী, রাজীব গাঁধী, নরসিংহ রাওয়ের মতোই কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসাবে সনিয়া গাঁধীও বারংবার রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি হিসাবে হিন্দুত্বের প্রতীকের রাজনৈতিক ব্যবহার করিয়াছেন, ফলও পাইয়াছেন। কিন্তু নির্বাচনী লাভের কড়ি হাতে পাইবার সঙ্গে আদর্শগত মূল্যের ক্ষতিও তাঁহাদের হজম করিতে হইয়াছে। প্রমাণ হইয়াছে, কত দুর্বল, অনিশ্চিত কংগ্রেসের আদর্শ-অবস্থান। প্রমাণ হইয়াছে, হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তা রাজনীতির অ্যাজেন্ডা তৈরি করে, কংগ্রেসি জাতীয়তা তাহাকে অনুসরণ করে। বুঝা গিয়াছে, হিন্দুত্বের প্রশ্নে কংগ্রেসের সমঝোতার কারণে ভারতীয় গণতন্ত্রে বহুত্ববাদের পরিসরটি কী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিবেকানন্দ-প্রশ্নে বিজেপি-নীতির উত্তরে সনিয়া গাঁধীর প্রতিক্রিয়া কংগ্রেসের নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজি হিসাবে যতই সফল হউক, দীর্ঘমেয়াদে কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তার প্রতিশ্রুতি ইহাতে আরও এক বার অন্তঃসারহীন হইয়া পড়িল। |