|
|
|
|
হাফলঙের সভায় আর্জি, আর হিংসা নয় |
রাজীবাক্ষ রক্ষিত • হাফলং |
রাত থেকে টানা বৃষ্টি। পাহাড়ি শহরের ধাপে ধাপে জমা মেঘ। তার মধ্যেও ঐতিহাসিক চুক্তির উষ্ণতার আঁচ পোহাচ্ছে হাফলং। প্রায় দু’দশকের লড়াই শেষে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছে। ঐতিহাসিক চুক্তির পরে আজ ডিএইচডি চেয়ারম্যান দিলীপ নুনিসা ডিমাসা, অ-ডিমাসা সকলকে নিয়ে প্রথম জনসভা করলেন। জেলা গ্রন্থাগারের প্রেক্ষাগৃহে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কিন্তু লড়াই কি শেষ হল? আম জনতা বলছেন, অবশেষে হল। কিন্তু নেতারা বলছেন মোটেই না। বরং কেন্দ্র, রাজ্যের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক চুক্তিটা যুদ্ধজয়ের প্রথম ধাপ। ডিমারাজির জন্য আন্দোলন চালানো ডিমাসা নেতারা হাফলং-এর জনসভায় ঘোষণা করলেন, পৃথক ডিমাল্যান্ড এর জন্য আন্দোলন নতুন করে শুরু হল। এ দিকে, দিল্লিতে একসঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে আসার পরেও ঘরে ফিরে, ফের ডিমা হালমা ডাওগের নুনিসা গোষ্ঠী ও জুয়েল গোষ্ঠীর মুখ দেখাদেখি বন্ধ। এই পরিস্থিতিতে চুক্তি-উত্তর ডিমা হাসাও জেলার ভবিষ্যৎ নিয়ে ধোঁয়াশা কিন্তু কেটেও যেন কাটছে না।
১৯৯১ সাল থেকে পৃথক ডিমারাজি বা ডিমাল্যান্ডের দাবিতে সুথিল ফংলো, দিলীপ নুনিসা, লজ দাওলাগোপু ও সানমণি কেম্প্রাই-এর নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়। নিরস্ত্র আন্দোলনে কাজ না হওয়ায়, ১৯৯৫ সাল থেকে দিলীপ নুনিসার নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়। বিস্তর রক্তপাতের পরে ২০০৩ সালে সংঘর্ষবিরতি। কিন্তু শান্তি স্থায়ী হয়নি। জুয়েল গার্লোসা, নিরঞ্জন হোজাইয়ের হাত ধরে গড়ে ওঠে সংগ্রামপন্থী ডিএইচডি (জুয়েল) বা ব্ল্যাক উইডো। তাদের দৌরাত্ম্যে গত এক দশক ধরে উত্তর কাছাড়ের উন্নয়ন, ব্রডগেজ লাইন পাতার কাজ থমকে ছিল। হিংসা, রক্তপাতে ক্লান্ত ডিমা হাসাওয়ের মানুষের কাছে তাই ৮ অক্টোবরের গুরুত্ব অসীম। এই চুক্তি নিয়ে জনতা কতটা উৎফুল্ল তার প্রমাণ গত কালই মিলেছে। দিলীপ, সানমণি, প্রণব নুনিসাদের নিয়ে ৪০টি গাড়ি ও ১০০টি বাইকের কনভয়কে নগাঁও থেকে হাফলং আসার পথে ১৬ বার, গণ-সম্বর্ধনা নেওয়ার জন্য থামতে হল।
আজকের সভা ছিল ভয় কাটানোর সভা। ডিমাসা জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে কেন্দ্রের চুক্তির পরে এই জেলাকে তিনটি জেলায় ভাগ করা হবে। অ-ডিমাসাদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে, এ বার হয়তো তাঁদের ভিটেছাড়া হতে হবে। তাঁদের সেই ভয়কে হাতিয়ার করেই মার নেতা আথং লিয়েনথাং গড়ে তুলেছেন ইন্ডিজেনাস পিপল্স ফ্রন্ট। তাঁদের ডাকা বন্ধে অশান্ত হয়ে উঠেছে হাফলং।
কিন্তু আজকের জনসভায় দিলীপ সাফ জানালেন, ডিমা হাসাও যতটা তাঁদের ততটাই বাকি উপজাতিদেরও। কারও প্ররোচনায় কান দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সেই সঙ্গে দলের ক্যাডারদের কোনও কাজে কেউ দুঃখ পেয়ে থাকলে, ক্ষমাও চেয়ে নিলেন তিনি। দিলীপ একা নন, নেপালি, কুকি, জেমি নাগা, রাংখল, বাইতে, জয়ন্তিয়া, খাসিয়া, খেলমা, মার ও বাঙালি সংগঠনের নেতারাও মঞ্চ থেকে দিলীপের গলায় গলা মেলালেন। তাঁদের আহ্বান, ‘‘অশান্তি তো অনেক হল। এ বার দয়া করে, শান্তি ফিরিয়ে আনুন পাহাড়ি জেলায়। ফিরে আসুক উন্নয়ন, গড়ে উঠুক সড়ক, পরিকাঠামো।’’
আজ ‘ঐতিহাসিক জনসভা’-র দিনেও ডিএইচডির দুই গোষ্ঠীর বৈরী কিন্তু স্থায়ী শান্তির পথে কাঁটা হয়েই থাকল। আজকের সভায় হাফলং-এর সব উপজাতির প্রতিনিধিরা, এমন কী শিলচর থেকে অল কাছার-করিমগঞ্জ-হাইলাকান্দি ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিরাও সভায় হাজির থেকে নুনিসাকে অভিনন্দন জানালেন। কিন্তু সভায় জুয়েল গোষ্ঠীর কোনও প্রতিনিধিই হাজির ছিলেন না। দিলীপ পন্থীরাও সাফ জানালেন, জুয়েলের দলের সঙ্গে তাঁদের তেমন বাক্যালাপ নেই। জুয়েল এনআইএ মামলার শুনানির জন্য গুয়াহাটিতে। তার গোষ্ঠীর তরফেও কেউ দিলীপের সভায় না আসায় ‘ঐক্যবদ্ধ’ লড়াইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা রয়েই গেল। তবে সভার বক্তাদের কথাতে ঘুরেফিরে এল সেই আর্তি, ‘‘যা অর্জন করা গিয়েছে, তার জন্য বহু রক্ত ঝরেছে। এ বার হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার সময়। না হলে ইতিহাস আপনাদের ক্ষমা করবে না।’’ |
|
|
|
|
|