ঝাঁটা থেকে সোনা, চিনের নিঃশব্দ অনুপ্রবেশ উত্তর-পূর্বে
সাপের তেল থেকে তৈরি চিনা ফেয়ারনেস ক্রিম পাবেন!
চিনা ঝাঁটা, চিনা চাল, চিনের মোটরবাইক, চিনা সিল্ক, সোনা, চিনা চন্দন তা-ও পাবেন!
চিন থেকে চোরা পথে আসা প্যাঙ্গোলিন, লেপার্ডের চামড়া একটু খুঁজলেই সে সবও দিব্যি পাওয়া যাবে!
চিনে তৈরি মাদক-ট্যাবলেট, অস্ত্র আড়ালে আবডালে সে সবও মিলবে। বিক্রির জন্য নির্দিষ্ট এজেন্ট আর ক্রেতা আছেন।
মশলা থেকে মশার তেল, গামছা থেকে গ্রেনেড, সব কিছুই চিনের এবং তা ব্যবহার হচ্ছে ভারতীয় ভূখন্ডের এই ছোট্ট-পাহাড়ি শহরের ঘরে-ঘরে।
শহরের নাম মোরে। রাজ্য, মণিপুর।
অর্থনৈতিক অনুপ্রবেশ একেই বলে। দেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত, বিশেষ করে অরুণাচল প্রদেশে চিনের সামরিক অনুপ্রবেশ নিয়ে ভারতের সঙ্গে টানাপোড়েন দীর্ঘদিনের। সেখানে সেনা মোতায়ন নিয়ে দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক বিবৃতির লড়াই-ও অব্যাহত। কিন্তু নিঃশব্দে ভারতীয় অর্থনীতির রন্ধ্রে অনুপ্রবেশের যুদ্ধে চিন যে এইভাবে আগ্রাসী, তা এই মোরে-তে না-এলে বুঝতে পারতাম না।
মোরের বাজারের প্রত্যেকটি দোকান চিনা জিনিসে ঠাসা।
‘ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স’-এর মিডিয়া ট্যুরে মণিপুরের ‘ঘুরে-দেখা’ জায়গার তালিকাতে ছিল মোরে। শহরটার সম্পর্কে ধারণা দেওয়া যাক। মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের উপরে গড়ে ওঠা সীমান্ত-বসতি। ওপারেই মায়ানমারের সাঙ্গিং ডিভিশনের তামু শহর। এতটাই পাশাপাশি যে, মোরে-র রাস্তায় কেউ ব্যাটে ছয় মারলে তামুর রাস্তায় গিয়ে পড়বে। প্রায় ২০ হাজার মানুষ থাকেন মোরেতে। কুকিদের সংখ্যাধিক্য। প্রচুর তামিলও রয়েছেন। আছে ১০-১৫টি বাঙালি পরিবার। সবাই মূলত ব্যবসায়ী। তৃণমূল কংগ্রেসের এখানে ব্যাপক রমরমা। প্রচুর সমর্থক।
বছর দশেক আগে এই মোরের মধ্যে দিয়েই ভারত-মায়ানমার বাণিজ্যে সায় দিয়েছিল দুই দেশ। চুক্তি সই হয়েছিল। আদানপ্রদানের তালিকায় ছিল মোট ৪০টি জিনিস। ঠিক হয়েছিল, সকাল ৭টায় খুলে যাবে মোরে-তামু সীমান্ত। ব্যবসায়ীরা দু’দেশের মধ্যে ১৭ কিলোমিটার পর্যন্ত গিয়ে নিজেদের জিনিস বিক্রি করতে পারবেন। তবে বিকেল চারটের আগে আবার নিজের-নিজের দেশে ফিরে আসতে হবে।
ভারতের ব্যবসায়ীরা যেতে পারবেন মায়ানমারের খুনজাং পর্যন্ত, আর মায়ানমারিদের পরিধি ছিল মণিপুরের খুদেনথাবি। প্রায় ২ হাজার লোক প্রতিদিন এখানে যাতায়াত করেন। কিন্তু মণিপুরে চেম্বার অফ কমার্সের সীমান্ত-বাণিজ্য শাখার কর্তারাই জানালেন, খোলা-বাণিজ্য চালু হওয়ার পরেই তা চলে যায় মণিপুরের সাতটি প্রধান জঙ্গি সংগঠনের কোঅর্ডিনেশন কমিটি ‘কোরকম’-এর হাতে। তাদের হাত ধরেই মায়ানমার হয়ে হুহু করে মোরেতে ঢুকতে থাকে চিনের জিনিস। ছড়িয়ে পড়তে থাকে ভারতীয় ভূখণ্ডে। এ সব জিনিসের কথা চুক্তিতে ছিলই না। লক্ষ লক্ষ টাকার বেআইনি ব্যবসার আখড়া হয়ে ওঠে মোরে। সেখানে রাস্তায় এখন অবাধে যাতায়াত করে নম্বর-প্লেট বিহীন চিনা মোটরবাইক। চিনা জিনিস ছাড়া সেখানে গেরস্থালি কল্পনাই করা যায় না।
ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্সের সীমান্ত-বাণিজ্য শাখার জনসংযোগ অফিসার কে সুব্রহ্মণ্যম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলছিলেন, “২৪ অসম রাইফেলসের জওয়ানেরা অষ্টপ্রহর পাহাড়ায় থাকে। সবসময় খানাতল্লাশি হয়। তার উপর মণিপুর পুলিশও রয়েছে। কিন্তু সব উপর-উপর। জঙ্গিরা যাতে শহরে বেশি গোলমাল না-বাঁধিয়ে চুপচাপ চোরাচালান চালিয়ে যায় তার জন্য পুলিশই ওদের গোপনে টাকা জোগায়। যে সব ব্যবসায়ী এখানে বৈধ ব্যবসা চালাতে চান, তাঁদের সবচেয়ে সমস্যা।” কী রকম? সুব্রহ্মণ্যম-এর কথায়, “মণিপুরের জঙ্গি সংগঠনগুলো সব মায়ানমারে গিয়ে ঘাঁটি গেড়েছে। সেখান থেকেই তারা হুমকি দিয়ে মোরের ব্যবসায়ীদের থেকে তোলা আদায় করে। তামুতে নাফলং বাজার আছে। মোরের ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সময়ে ওই বাজারেই ডেকে পাঠায় জঙ্গিরা। মোটা টাকা দিতে হয়। কোনও দেশের সরকারই এর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয় না।” এ দিকে, মোরের রাস্তায় এক কিলোমিটার যেতে-না-যেতেই চোখে পড়বে অসম রাইফেলস-এর লাগানো হোর্ডিং, “জঙ্গিদের ভুলেও কোনও অর্থসাহায্য করবেন না।”
মোরে ও তামুর মধ্যে সংযোগ এই সেতু।
মোরের নিরাপত্তায় গত অগস্ট মাস থেকে মণিপুর পুলিশের ৪০ জন কম্যান্ডোর একটা বিশেষ দল আনা হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে ইম্ফল-মায়ানমার ৩০ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন একদল বিক্ষুব্ধ জনতা। তাঁদের অভিযোগ ছিল, পুলিশি প্রহরা বাড়লে নাকি মোরেতে জঙ্গিদের উৎপাত বাড়বে! মোরের স্থানীয় বাসিন্দাদের অধিকাংশ এবং অসম রাইফেলস-এর জওয়ানেরাই বলছেন, বিক্ষোভ করানোর পিছনে আসলে সেই জঙ্গিরাই। কম্যান্ডো থাকলে চিন থেকে আনা পণ্যের বেআইনি ব্যবসা মার খেতে পারে এই আশঙ্কাতেই কম্যান্ডো হঠানোর এটা একটা ফন্দি।
মায়ানমারের খুনজাং শহরে একটা বড় বাজার রয়েছে। যেখানে খুল্লমখুল্লা চিনের তৈরি অস্ত্র বিক্রি হয় বলে মোরের ব্যবসায়ী ও অসম রাইফেলস সূত্রের খবর। মণিপুর পুলিশের কম্যান্ডোরাই বললেন, মণিপুর নদী পেরিয়ে চোরাচালানকারীরা চান্ডিলের জঙ্গল পায়ে হেঁটে পার হয়ে অস্ত্র নিয়ে মোরে-তে ঢুকছে। সেখান থেকে অস্ত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে, অনেক কম দামে। বাণিজ্যপথেই উত্তর-পূর্বে চিনের অনুপ্রবেশ ঘটে যাচ্ছে নিঃশব্দে।

—নিজস্ব চিত্র


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.