রাজ্যে মাওবাদী দমন অভিযানের সর্বাধিনায়ক হতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুরোধ জানালেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে।
দু’বছর আগে এই লক্ষ্যে যে ‘ইউনিফায়েড কম্যান্ড’ গঠন করা হয়েছিল, আপাতত তার শীর্ষে রাজ্যের মুখ্যসচিব। কিন্তু কেন্দ্রের বক্তব্য, শুধু সশস্ত্র অভিযান নয়, মাওবাদী সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রে সামগ্রিক নীতি নির্ধারণও এই কম্যান্ডের কাজের মধ্যে পড়ে। যেমন, কী ভাবে উন্নয়নমূলক কাজ করে মাওবাদীদের অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলা যায়, তা-ও ঠিক করে এই কম্যান্ড। যা মূলত রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাজ। ফলে কম্যান্ডের দায়িত্বে মুখ্যমন্ত্রী থাকলে তা অনেক বেশি কার্যকর হয়ে উঠতে পারবে। সেই দায়িত্ব নিতে অনুরোধ জানিয়ে মমতাকে চিঠি দিয়েছেন শিন্দে। তবে এই অনুরোধ মমতা রাখবেন কি না, তা নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের মধ্যেই সংশয় আছে।
২০১০-এর জুলাইয়ে নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের উপস্থিতিতে মাওবাদী অধ্যুষিত রাজ্যগুলির এক বৈঠকের পরে ‘ইউনিফায়েড কম্যান্ড’ গঠনের কথা ঘোষণা করেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম। উদ্দেশ্য, কেন্দ্রীয় আধা-সামরিক বাহিনী এবং রাজ্যের বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে মাওবাদী দমন অভিযানে গতি আনা। পাশাপাশি, উপদ্রুত এলাকায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড শুরু করা।
বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ অবশ্য তখনই এই ধরনের ব্যবস্থায় রাজি হয়নি। ঠিক হয়, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড এবং ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যসচিবদের নেতৃত্বে রাজ্যভিত্তিক ‘ইউনিফায়েড কম্যান্ড’ গঠিত হবে। (পরে অবশ্য ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রীই এই দায়িত্ব নেন) যাতে সেনাবাহিনীর এক জন অবসরপ্রাপ্ত অফিসারও থাকবেন।
কিন্তু গত দু’বছরে কোনও রাজ্যের ‘ইউনিফায়েড কম্যান্ড’ই কার্যত কাজ করেনি বলে মনে করছে কেন্দ্র। প্রাথমিক ভাবে মাসে এক বার কম্যান্ডের বৈঠক হবে বলে ঠিক থাকলেও কার্যক্ষেত্রে দীর্ঘদিন কোনও বৈঠক হয়নি। ছত্তীসগঢ়ে শেষ বার বৈঠক হয়েছে গত বছর জুলাইয়ে। ঝাড়খণ্ডে গত বছর অগস্টে। চলতি বছর মার্চে পশ্চিমবঙ্গে এবং অগস্টে বৈঠক হয়েছে ওড়িশায়। শিন্দে তাঁর চিঠিতে বলেছেন, বছরে অন্তত চারটি বৈঠক হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। ‘ইউনিফায়েড কম্যান্ডের’ কাজের এই ঢিলেঢালা ভাব নিয়ে গত মাসে নয়াদিল্লিতে রাজ্যের পুলিশ প্রধানদের বৈঠকেই উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তখনই ঠিক হয়েছিল, বাকি তিন মুখ্যমন্ত্রীকে নিজের নিজের রাজ্যের ‘ইউনিফায়েড কম্যান্ডের’ নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ করা হবে। সেই মতো মমতাকে চিঠি পাঠিয়েছেন শিন্দে। তাতে তিনি আরও লিখেছেন, “ইউনিফায়েড কম্যান্ডের সিদ্ধান্তগুলি বাস্তবায়িত করার উপরে নজরদারি চালাতে একটি ছোট সচিবালয় গঠন করা যেতে পারে।”
মুখ্যমন্ত্রীদের কেন ‘ইউনিফায়েড কম্যান্ডের’ মাথায় চাইছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক?
শিন্দের মতে, মাওবাদী দমনের কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কম্যান্ডই শেষ কথা। তার মাথায় মুখ্যমন্ত্রীরা থাকলে তবেই তার পক্ষে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশের মতে, এর পিছনে কেন্দ্রের অন্য কৌশলও কাজ করছে। মাওবাদী দমন প্রক্রিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও জুড়তে চায় তারা। যাতে ভবিষ্যতে ভিন্ন পরিস্থিতিতে তাঁদের পক্ষে ভিন্ন সুরে গাওয়া সম্ভব না হয়।
কিন্তু তিন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা কৌশলগত কারণেই ‘ইউনিফায়েড কম্যান্ড’ থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী, বিজেপি-র রমন সিংহ সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে মাওবাদী দমনের পক্ষপাতী হলেও বাকি মুখ্যমন্ত্রীরা মূলত রাজনৈতিক পথেই এর মোকাবিলা করতে চান। কিন্তু ‘ইউনিফায়েড কম্যান্ড’ কার্যত রাজ্যে ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ অভিযানের নিয়ন্ত্রকে পরিণত হয়েছে। ফলে রাজনৈতিক কারণেই মুখ্যমন্ত্রীদের পক্ষে তার শীর্ষে বসা সম্ভব হয়নি।
মমতা এখন কী করবেন? মহাকরণ সূত্রের খবর, তিনি অন্য দুই মুখ্যমন্ত্রী সঙ্গে কথা বলবেন। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তাও বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী আমাদের মতামত চেয়েছেন। তিনি মাথায় থাকলে কম্যান্ড পরিচালনায় একাধারে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক অভিমুখ নির্দিষ্ট হয়ে যাবে।” কিন্তু বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন ‘গ্রিন হান্টের’ প্রবল বিরোধিতা করা মমতার পক্ষে এখন সেই অভিযানেরই নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব কি না, সে প্রশ্ন থাকছেই। সমস্যা অন্য মুখ্যমন্ত্রীদের ক্ষেত্রেও। রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তারা বলেন, ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক কি ৭-৮টি আদিবাসী প্রভাবিত জেলায় নিজেকে মাওবাদী দমন নীতির মূল প্রবক্তা হিসেবে তুলে ধরতে চাইবেন? আবার ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন মুন্ডার পক্ষেও নিজেকে খনি এবং পিছিয়ে পড়া এলাকার মানুষের কাছে মাওবাদী নিকেশের নেতা হিসেবে তুলে ধরা মুশকিল।
মুখ্যমন্ত্রী ‘ইউনিফায়েড কম্যান্ডের’ মাথায় বসলেই মাওবাদী দমনে গতি আসবে, এমন তত্ত্বও মানতে নারাজ রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের একাংশ। তাঁদের মতে, তা হলে তো ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদী দমনে সব চেয়ে ভাল কাজ হওয়ার কথা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তো তা হয়নি। উল্টে পশ্চিমবঙ্গকেই ভাল কাজের জন্য বাহবা দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
কিন্তু ‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার পক্ষে সব চেয়ে বড় বিপদ’ মাওবাদীদের নিছক আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হিসেবে দেখতে নারাজ কেন্দ্র। তাদের মতে, মাওবাদী দমনে প্রতি রাজ্যের রাজনৈতিক দিশা এক হওয়া দরকার। মুখ্যমন্ত্রীদেরই সেই দায়িত্ব নিতে হবে।
তবে শেষ পর্যন্ত মমতাদের রাজি করানো সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে প্রশাসনের একাংশই। |