রাস্তা দিয়ে পাগলের মতো দৌড়চ্ছিল মেয়েটা। আর চেঁচিয়ে বলছিল, ‘বাঁচাও, বাঁচাও, কাকিমা আমাকে মেরে ফেলল!’ পড়শিরা ছুটে যেতেই বছর বারোর মেয়েটি জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। পরে জানা যায়, স্কুলশিক্ষিকা বাড়ির কর্ত্রী সাঁড়াশি দিয়ে এমন মার মেরেছেন, যে প্রাণ বাঁচাতেই সে দৌড় লাগায়।
মঙ্গলবার বিকেলে পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের ঘটনা। বুধবার সকালে অভিযোগ পেয়ে পুলিশ সোমাঞ্জলি বেরা (প্রধান) নামে ওই শিক্ষিকাকে গ্রেফতার করলেও পরে আদালত থেকে তিনি জামিন পান। সারা দেহে আঘাত থাকা সোমাঞ্জলির বাড়ির পরিচারিকা সোমা শীট বান্দোয়ান ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসাধীন। সোমাঞ্জলি শুধু বলেছেন, “ভুল করে ওকে মারধর করেছি।” যদিও সোমার অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরেই সোমাঞ্জলি তার উপরে অত্যাচার চালান। প্রতিবেশীরা মঙ্গলবার রাতেই শিক্ষিকার বাড়িতে বিক্ষোভ দেখান।
প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও। পুরুলিয়া জেলার সহকারী শ্রম কমিশনার প্রসেনজিৎ কুণ্ডু বলেন, “১৪ বছরের কম বয়েসীকে বাড়িতে পরিচারকের কাজ করানো জামিন-অযোগ্য অপরাধ। এ ক্ষেত্রে পুলিশ ওই শিক্ষিকার বিরুদ্ধে কেন শিশুশ্রম বিরোধী আইনে মামলা রুজু করেনি, তা খোঁজ নেব।” জেলার পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, “তদন্ত চলছে। কিশোরীর বয়েস সম্পর্কেও খোঁজ নেওয়া হবে। সব দিক খতিয়ে দেখেই আমরা ব্যবস্থা নেব।” জেলা পুলিশের এক আধিকারিকের বক্তব্য, “প্রাথমিক ভাবে মারধরের যে অভিযোগ থানায় হয়েছে, তার ভিত্তিতে মামলা হয়েছে। কিশোরীর ‘ইনজুরি রিপোর্ট’ পেলে এবং তদন্তের আরও অগ্রগতি হলে প্রয়োজনে আরও ধারা যোগ করা হবে।” |
স্থানীয় চাঁনড়া আপার প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা সোমাঞ্জলি তাঁর বছর দেড়েকের মেয়েকে নিয়ে বান্দোয়ান বাজার এলাকায় ভাড়া বাড়িতে থাকেন। তাঁর বাপের বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং থানার বোনাই গ্রামে।স্বামী রাজকুমার প্রধানও সবংয়ের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। মেয়ের দেখাশোনা ও বাড়ির কাজের জন্য সোমাঞ্জলি সবংয়েরই বাগবেড়িয়া গ্রাম থেকে সোমাকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। বুধবার সকালে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বসে সোমা জানায়, মঙ্গলবার বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে সোমাঞ্জলি মেয়ের জন্য তাকে দুধ গরম করতে বলেন। দুধ গরম হয়ে গেলে তিনি জল গরম করবেন বলে সোমাকে গ্যাস নেভাতে বারণ করেন। কিন্ত, সোমা গ্যাস নিভিয়ে দেওয়ায় শিক্ষিকা খেপে যান।
|
অভিযুক্ত শিক্ষিকা
সোমাঞ্জলি বেরা। |
সোমা বলে, “কাকিমা জল গরম করতে দেরি করলে গ্যাস নষ্ট হবে ভেবেই ওভেন নিভিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু কাকিমা তা না বুঝে সাঁড়াশি দিয়ে আমার পেটে মোচড় দেয়। তার পর সাঁড়াশি দিয়ে বেধড়ক পেটাতে থাকে। শেষে মাথায় সাঁড়াশির ঘা পড়তেই মনে হল মরে যাব। এত দিন মুখ বুজে সব সহ্য করলেও এ বার আর থাকতে পারিনি। বাঁচার জন্য দরজা খুলে দৌড় লাগাই।”
বন্দোয়ান স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক ধুরমল কিস্কু বলেন, “মেয়েটির সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন। মাথায় গভীর ক্ষত রয়েছে। হাতে, পায়ে ও পিঠে পুরনো ক্ষত দেখে মনে হচ্ছে, ধারালো কিছু জিনিস দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল।” সোমাঞ্জলিদেবীর বাড়িওয়ালা গ্রহণচন্দ্র মাহাতো বলেন, “মাঝে মধ্যেই ওই শিক্ষিকার ঘর থেকে মেয়েটিকে মারধর করার চিৎকার শোনা যেত। এক দিন আমার স্ত্রী প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল। তার সঙ্গেও দুব্যর্বহার করা হয়।”
মঙ্গলবার গভীর রাতে বান্দোয়ানে আসেন সোমার মা আরতি শীট ও জেঠা অজিত শীট। এসেছেন সোমাঞ্জলির স্বামীও। আরতিদেবী বলেন, “ছ’বছর ধরে স্বামী নিরুদ্দেশ। আমিও পরিচারিকার কাজ করি। ভেবেছিলাম সোমাঞ্জলির কাছে মেয়েটা ভাল থাকবে। কিন্তু, এমন অত্যাচার হত মেয়ে আগে জানায়নি।’’ সোমা বলে, “কারণে-অকারণে কাকিমা আমাকে মারধর করত। কিন্তু বাড়িতে জানালে কাজ চলে যাওয়ার ভয়ে সব সহ্য করে যাচ্ছিলাম।”
|