অদৃষ্টের কী অদ্ভুত পরিহাস!
সার্ধশতবর্ষে স্বামী বিবেকানন্দ হঠাৎই ভারতীয় রাজনীতির উপকরণ হয়ে পড়লেন।
গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রচারের প্রধান হাতিয়ার স্বয়ং বিবেকানন্দ। তাঁর রথের নাম বিবেকানন্দ রথ। বিবেকানন্দের ছবি দেওয়া ব্যাট-বল বিলি করছেন অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে। আর বিবেকানন্দের ছবি দেওয়া টি-শার্ট। মোদীর বক্তৃতায় বিবেকানন্দের বাণী।
এই ‘শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা’ দেখে ক্ষুব্ধ রামকৃষ্ণ মিশন। বেলুড় মঠের সাধারণ সম্পাদক স্বামী সুহিতানন্দ একটি চিঠি দিয়ে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এ ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রামকৃষ্ণ মিশনের বক্তব্য, বিবেকানন্দকে যে কেউ শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। কিন্তু ব্যাটে-বলে বিবেকানন্দের ছবি দেওয়া শ্রদ্ধা প্রকাশের সুষ্ঠু পরিচয় নয়। এই ছবিগুলি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন। বেলুড় মঠের বক্তব্য, তাঁদের সঙ্গে ভোট বা রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁরা স্বামী বিবেকানন্দের মর্যাদাহানির বিপক্ষে।
নরেন্দ্র মোদীও কিন্তু ‘স্পোর্টসম্যান’। তিনি জানিয়েছেন, বিবেকানন্দকে অশ্রদ্ধা করা তাঁর অভিপ্রায় নয়। বিবেকানন্দের মতাদর্শকে নবীন প্রজন্মের কাছে প্রচার করাই তাঁর লক্ষ্য। এই ব্যাট-বলে ছবি ব্যবহার তাঁর নির্দেশেও হয়নি। অতি উৎসাহে কেউ করে থাকতে পারেন। রামকৃষ্ণ মিশন যদি আহত হয়, তবে তিনি ওই ছবিগুলি প্রত্যাহার করে নিতে রাজি। |
নরেন্দ্র মোদীর বিবেকানন্দ-চর্চা অবশ্য রাজনীতিতে যে প্রভাব ফেলেছে, তার প্রমাণ, রাজকোট রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে গিয়েছিলেন সনিয়া গাঁধীও। ৩ অক্টোবর নির্বাচনী প্রচারে যোগ দিতে গিয়ে জনসভায় যাওয়ার আগে রাজকোট আশ্রমে যান তিনি। গুজরাতে রামকৃষ্ণ মিশনের তিনটি আশ্রমের মধ্যে সব চেয়ে বড়টি রাজকোটে। সেখানে ঠাকুরের মূর্তির সামনে কিছু ক্ষণ বসেন সনিয়া। পরে বলেন, “ঠাকুর, মা এবং স্বামীজির প্রতি আমার গভীর বিশ্বাস। আজ নয়, দীর্ঘ দিনের।” তিনি বলেন, “আমার শাশুড়ি নিয়মিত বেলুড় মঠে যেতেন। ভরত মহারাজের সঙ্গে দেখা করতেন। আমি দিল্লি আশ্রমে স্বামী গোকুলানন্দের কাছে যেতাম। বিবেকানন্দ ভাবনা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের পরিবারকে রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত করেছে।”
গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী গত এক মাস ধরে একটি রথে স্বামী বিবেকানন্দের নাম নিয়ে রাজনৈতিক যাত্রা চালাচ্ছেন। গত মাসের ১১ তারিখ তিনি উত্তর গুজরাতের মন্দির-শহর বাহুচারাজি থেকে শুরু করেন স্বামী বিবেকানন্দ যুবযাত্রা। সেই যাত্রায় বহু জায়গাতেই বিবেকানন্দের বড় ছবি, কাট-আউট দেখা গিয়েছে। দলমত নিরপেক্ষ ভাবে নেতারা অনেকেই মনে করছেন, এই যাত্রার মাধ্যমে মোদী এক দিকে যেমন নিজের হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তি অটুট রাখতে চাইছেন, অন্য দিকে পৌঁছতে চাইছেন বাকি সম্প্রদায়গুলির কাছেও। তাই যাত্রার সময় তিনি বিভিন্ন প্রান্তে সংখ্যালঘু এবং দলিত নেতাদের সঙ্গেও দেখা করেছেন। তাঁর যাত্রায় ভিড়ও হয়েছে ভালই। লিম্বডি শহরে যাত্রায় যোগ দেন প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। গত সপ্তাহে মোরবি-তে এসেছিলেন হাজার পনেরো। বিজেপি-র পক্ষ থেকে আগেও রথযাত্রা হয়েছে। বিশেষ করে আডবাণী বিভিন্ন রথযাত্রা করেছেন। তবে এখন অনেকেই বলছেন, মোদী এ বার বিবেকানন্দের নামে রথযাত্রা করে দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার লড়াইয়েও এগিয়ে থাকতে চাইছেন।
|
মোদী যে বিবেকানন্দকে রাজনীতির তাস হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন, তারই মোকাবিলায় নেমেছেন সনিয়া। সেই কারণে রাজকোটের আশ্রমে গিয়ে তিনি প্রথমেই ছক্কা মেরেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, নরেন্দ্র মোদী বা বিজেপি কিন্তু বিবেকানন্দের ‘হোলসেলার’ নন। নেহরু-গাঁধী পরিবারের সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশনের একাত্মতা দীর্ঘদিনের। মোদীর ঢাকঢোল পিটিয়ে যাত্রার পাশে তাঁর এই ছোট্ট কাজটা তাই গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিবেকানন্দ নিজে ১৮৯০ সালে ‘ভারত দর্শন যাত্রা’ করেছিলেন। পাঁচ বছর ধরে চলেছিল সেই যাত্রা। সে সময় দেশের নানা প্রান্তে মহারাজা, শিল্পী এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আচার্যদের সঙ্গে দেখা করেছেন। তবে রাজকোটের আশ্রমটি তিনি দেখে যেতে পারেননি। এটি তৈরি হয়েছিল ১৯২৭ সালে, স্বামী বিবেকানন্দ মারা যাওয়ার ২৫ বছর পরে।
মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী থেকে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ বা রাধাকৃষ্ণন, কে যাননি সেই আশ্রমে! এ বার সনিয়া যখন রাজকোটে যান, সেখানকার ভারপ্রাপ্ত সন্ন্যাসী স্বামী সর্বস্থানন্দ তাঁকে বিবেকানন্দের একটি ছবি উপহার দেন। পরে স্বামী সর্বস্থানন্দ জানান, সনিয়া এসেছিলেন সাধারণ দর্শনার্থীর মতোই।
অতএব বিবেকানন্দ যেমন নরেন্দ্র মোদীর, তেমনই সনিয়া গাঁধীরও। |