প্রতিরোধের দিশাও নাছোড় কেন স্তন ক্যানসার,
উত্তর পেল কলকাতা
প্রশ্নটা অনেক দিন ধরে ছিল। চলছিল উত্তরের খোঁজও। দেশে দেশে।
এ বার কলকাতারই এক দল চিকিৎসক-বিজ্ঞানী দাবি করলেন, উত্তরটা তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন। জেনেছেন, কেন কেমোথেরাপির পরেও বহু ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসার ফিরে আসে। কেন স্তন ক্যানসারের বহু রোগী সেরে ওঠার বছর কয়েকের মধ্যে ফের আক্রান্ত হন এই মারণ রোগে।
শুধু উত্তর খুঁজে বার করাই নয়, রোগের প্রত্যাবর্তন প্রতিরোধের পথও বাতলেছেন কলকাতার গবেষকেরা। ‘আমেরিকান সোসাইটি অফ ক্লিনিক্যাল অঙ্কোলজি’র জার্নালে এবং স্তন ক্যানসার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক গবেষণা পত্রিকা ‘ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট ক্যানসার’-এ তাঁদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে।
স্বাস্থ্য-তথ্য বলছে, ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে দাপট যে সব ক্যানসারের, তার শীর্ষে স্তন ক্যানসার। শহুরে মহিলারাই এর শিকার হন বেশি। এবং চরিত্রেও এটি ‘নাছোড়বান্দা’ ঘরানার। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এক বার সেরে ওঠা মহিলার দেহে ফের থাবা বসানোর প্রবণতা রয়েছে স্তন ক্যানসারের। বিশেষজ্ঞদের মতে, গত দশ বছরে ভারতে স্তন ক্যানসারের চেনা চরিত্রে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছে। আগে মূলত পঞ্চাশের আশপাশের বয়সীরা এর কবলে পড়তেন। এখন কুড়ি, তিরিশ, এমনকী পনেরো-ষোলোর কিশোরীরাও স্তন ক্যানসারের শিকার! তাঁদের অনেকে কেমোথেরাপি করে সুস্থ হয়ে উঠছেন, অথচ ক’বছর বাদে রোগটা আবার ফিরে আসছে! কখনও স্তনে, কখনও বা অন্য অঙ্গে।
কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি কেন সমূলে বধ করতে পারছে না তাকে?
এটা জানা না-থাকায় বহু দিন পর্যন্ত স্তন ক্যানসারের প্রত্যাবর্তন প্রতিরোধের ছকও তৈরি করা যাচ্ছিল না। তবে একটা ইঙ্গিত মিলেছিল ২০০৮-এ, মার্কিন বিজ্ঞানীদের গবেষণায়। যাঁরা দেখেছিলেন, স্তন ক্যানসার ফিরে আসার পিছনে বিশেষ ধরনের ক্যানসার স্টেম সেলের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু কতটা ভূমিকা, তা নির্দিষ্ট ভাবে জানা যায়নি। স্টেম সেলগুলোর চরিত্র বা তাদের আক্রমণ প্রতিহত করার উপায় সম্পর্কেও কোনও তথ্য মেলেনি।
সেই দিশা পেতে ‘ব্রেস্ট ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ’-এর অনুমোদন নিয়ে গবেষণায় নেমেছিলেন কলকাতার সরকারি-বেসরকারি আটটি হাসপাতালের এক দল চিকিৎসক। সূত্র ছিল মার্কিন গবেষণা-রিপোর্ট। ব্রেস্ট ইন্টার গ্রুপ অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া (বিইজিইই)-র ওই সদস্যদের গবেষণায় স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগিণীদের ৯০ শতাংশের মধ্যেই বিশেষ স্টেম সেলটির অস্তিত্ব ধরা পড়ে। ‘উৎস’ নির্ধারণের পরে আসে প্রত্যাবর্তনের কারণ অনুসন্ধান। এবং সেখানেই প্রচলিত পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা টের পাওয়া গিয়েছে বলে গবেষকদের দাবি। কী রকম?
গবেষকদলের সদস্য আশিস মুখোপাধ্যায় জানান, ল্যাবরেটরিতে কোষগুলোর উপরে কেমোর ওষুধ প্রয়োগ করে তার প্রতিক্রিয়া দেখা হয়েছিল (বিজ্ঞানের পরিভাষায়, ইন ভিট্রো ড্রাগ সেনসিটিভিটি টেস্ট)। দেখা যায়, ৮০% কোষের উপরে রুটিন কেমো কোনও কাজ করছে না! তা হলে উপায় কী?
তখনই প্রচলিত পথের বাইরে হাঁটার চিন্তা শুরু হয়। আশিসবাবুর কথায়, “সাধারণত যে অঙ্গের ক্যানসারে যে ধরনের কেমো ব্যবহারের চল নেই, আমরা সেটাই প্রয়োগ করি। যেমন স্তন ক্যানসারে প্লাটিনাম গ্রুপের কেমো দেওয়া হয় না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০% ক্ষেত্রে সেটাই কাজ করছে! বাকি ক্ষেত্রে কেমোর বদলে ব্যবহার করা হয়েছে ক্যানসারের জিন প্রতিহত করার ওষুধ। তাতেও আশানুরূপ ফল এসেছে।”
আশিসবাবুদের গবেষণার ফল উৎসুক করে তুলেছে চিকিৎসকমহলকে। বিশেষজ্ঞদের আশা, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)-এর তত্ত্বাবধানে এ বার রোগীদের শরীরে নয়া পদ্ধতির প্রয়োগ সফল হলে ক্যানসার চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। “অন্ধের মতো কেমো প্রয়োগের দিন যে ফুরিয়েছে, এই জাতীয় গবেষণা সেই সত্যকে আরও বেশি করে সামনে আনছে। কোন ক্ষেত্রে রুটিন কেমো কাজ দেবে, কোন ক্ষেত্রে দেবে না, তা নিশ্চিত ভাবে বোঝার পরে চিকিৎসা শুরু হলে বেশি কাজ দেবে।” বলেন গবেষকদলের সদস্য সুদেষ্ণা গঙ্গোপাধ্যায়। ক্যানসার-চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “আধা ঘুমন্ত কিছু ক্যানসার কোষ, যারা কেমোথেরাপিতেও মরে না, উপযুক্ত পরিবেশ তাদের ফের জাগিয়ে তুলতে পারে। ফের মাথা চাড়া দিতে পারে মারণ রোগ। তাই এমন কেমো প্রয়োজন, যা ওই কোষগুলোকেও মারবে।”
উপযুক্ত পরিবেশ বলতে কী বোঝায়?
সুবীরবাবুর ব্যাখ্যা, “তার নানা রকমফের। জিনগত বা হরমোন সংক্রান্ত কারণ থাকতে পারে। দায়ী হতে পারে খাদ্যাভ্যাসও।” ক্যানসার-সার্জন গৌতম মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “স্তন ক্যানসার রোগীর অস্ত্রোপচারের পরে অনেক সময়ে অন্য অঙ্গে ক্যানসার ফিরে আসে। তা ঠেকাতে এই গবেষণা খুবই জরুরি।” ‘ফিরে আসার’ নেপথ্যে যারা, সেই স্টেম সেলগুলোকে চিহ্নিত করা যাবে কী ভাবে? আশিসবাবু বলেন, “ফ্লোসাইটোমেট্রি নামের যন্ত্রে স্তনের টিস্যু পরীক্ষা করে তা সম্ভব।” কিন্তু কোনও মহিলার স্তন অপারেশন করে বাদ দেওয়ার পরে ওই কোষের অস্তিত্ব বোঝা যাবে? আশিসবাবুর জবাব, “তখন স্তনের টিস্যু পাওয়া না-গেলেও বোন ম্যারো পরীক্ষায় তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যাবে।”
আপাতত খুব কম জায়গায় এই পদ্ধতি চালু রয়েছে। উপরন্তু হাজারো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জেরে মূল চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হবে না তো? আশিসবাবু বলেন, “প্রথমে রুটিন কেমোথেরাপি দিয়ে রোগ আটকানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। তার দু’-তিন সপ্তাহ বাদে বিকল্প ব্যবস্থা হবে।” বিকল্প ওষুধটা ঠিক হবে স্টেম সেল পরীক্ষার পরে। তাতে সপ্তাহ দুয়েক সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন আশিসবাবু।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.