চণ্ডীতলার আটচালায় ঠাকুর গড়ছেন হরিহর পাল। রং লাগানো সারা। তবে ঠাকুরের চোখ আঁকাটা বাকি এখনও। শিমূলতলি জুড়ে সাজ-সাজ রব। গ্রামের একমাত্র পুজো এটা। তাই তোড়জোড় তুঙ্গে। পাঠশালায় একরত্তি পড়ুয়ারা ‘এক-এক্কে এক দুয়েক্কে দুই’ নামতায় মুখ গুঁজে আছে, কিন্তু ওদের মন পড়ে সেই আটচালায়। কখন চারটে বাজবে, এক ছুট্টে পৌঁছে যাবে ঠাকুর গড়া দেখতে।
পুজো আসে, পুজো যায়। হরিহররা ঠাকুর গড়েন আপন খেয়ালে। তাঁদের গড়া ঠাকুরে লেগে থাকে ঐতিহ্যের গন্ধ। তাই সেই পুজো পুরনো হয়েও পুরনো হয় না। আর সেখান থেকে কয়েক ক্রোশ দূরে শহরগুলোর অলিগলিতে পুজো যে এখন একটা বড়সড় ‘ইন্ডাস্ট্রি’, সে খবরও তাঁদের কানে পৌঁছয় না সব সময়ে। শুধু কখনও-সখনও গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে থাকা লোকশিল্পের মণিমুক্তোগুলোকে খুঁজে এনে শহুরে পুজোর ঐশ্বর্যে ঠাঁই দেয় কোনও কোনও পুজোকমিটি। আর সেই সব শিল্পনৈপুণ্য দেখে অবাক হয় মহানগরের আমজনতা। এই যেমন পাইকপাড়ার রাজা মণীন্দ্র রোডের ‘৩১ পল্লি সাধারণ দুর্গোৎসব সমিতি’। এ বারের পুজোয় তারা মেদিনীপুরের এক অবলুপ্তপ্রায় শিল্পকে ফিরিয়ে এনেছে পুজোমণ্ডপে। সেখানে পাটকাঠির উপরে নানা কারুকাজ করে তা দিয়ে তৈরি হবে পুজোমণ্ডপ। মণ্ডপের আদলটা হবে অনেকটা বৌদ্ধ প্যাগোডার মতো।
উত্তরের ‘টালা বারোয়ারি’র পুজোর বেশ নাম-ডাক। এ বছর তারাও ফিরে তাকাবে ফেলে আসা সময়ের দিকে। আমাদের কিশোরবেলার ঝুলনযাত্রা তাদের এ বারের থিম। কী সুখের সময় ছিল আহা! শৈশবের হাজারো রঙে রঙিন! তারই এক রং ছিল ঝুলন। স্কুলের ছুটির অবসরে হরেক রকমের পুতুল দিয়ে, গ্রাম-গঞ্জ-পাহাড়ের মডেল বানিয়ে ঝুলন সাজানো হত বাড়ির বারান্দায় বা ছাদে। কোথাও তৈরি হত সবুজ মাঠ, কোথাও আবার যুদ্ধক্ষেত্র। এখনকার ছোটদের অত সময় কোথায়? পড়াশোনা-টিউশন-নাচ-গান-আঁকা সব কিছু নিয়ে মহা ব্যস্ত তারা। অগত্যা বড়দেরই ভাবতে হচ্ছে দুর্গাপুজোর জাঁকজমকে রাধা-কৃষ্ণের ঝুলনকে ফিরিয়ে আনার কথা।
থিমপুজোর মজাটা এখানেই। তাতে এক দিকে যেমন গাঁ-গঞ্জের অকৃত্রিম লোকশিল্পকে হাজির করা যায় শহুরে চোখের সামনে। অন্য দিকে আবার আনকোরা কিছু চিন্তার মাধ্যমে পরিবেশন করা যায় সচেতনতার বার্তা। ‘নলিন সরকার স্ট্রিট’-এর পুজোয় যেমন নতুনত্ব দেখা যাবে সেরামিকের কাজে। ফার্নেসে পুড়িয়ে তার উপরে রং করে সেরামিকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হবে গতি এবং স্থিতি, অর্থাৎ উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের সম্পর্ক। মণ্ডপের সামনে থাকবে সেরামিকের তৈরি তিনটি বড় ধুতরো ফুল। তারা আসলে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। মণ্ডপ ঘিরে থাকবে সেরামিকের লতানো গাছ। গর্ভগৃহের চাঁদোয়ায় থাকবে সূর্য, প্রাণশক্তির প্রতিরূপ। সাবেক প্রতিমায় সেজে উঠবে মণ্ডপ। ‘৪৭ পল্লি যুবকবৃন্দ’-র পুজোতেও বজায় থাকবে সাবেকিয়ানা। চন্দননগরের আলোর সাজ, আর আগুনের শিখার মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হবে মা-শক্তির রুদ্ররূপ।
‘হরিতকি বাগান সর্বজনীন’-এর পুজোয় এ বার ফিরে আসছে মধুবনী শিল্প। সেখানে পৌরাণিক নানা গল্পের চিত্রাবলী ফুটে উঠবে মধুবনীর মাধ্যমে। আর স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষে তাঁর চিন্তার অনুসরণে সারদাদেবীরূপে পূজিত হবেন দেবী দুর্গা। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও মনের কাঁটাটা খচখচ করে। বিশ্বায়নের মানচিত্রে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও উন্নয়নের রেখা ঊর্ধ্বমুখী। তবুও রোজ এই দেশের কোথাও না কোথাও শুধুমাত্র মেয়ে হওয়ার ‘অপরাধে’ অনেক কুঁড়িরই অনুমতি মেলে না সূর্যের আলো দেখার। কেউ ঝরে যায় ফোটার আগেই, কারও আবার ঠাঁই হয় আস্তাকুঁড়ে। হাজার বিলাস-ব্যসনের মধ্যিখানে এদের কথাও ভেবেছে মানিকতলার ‘কৃষ্ণবাগান নবজীবন সঙ্ঘ’। পুজোর হরেক খুশির মাঝে আমরাও তো চাই, ভাল থাকুক ভবিষ্যতেরা। |