পুরস্কার ঘোষণার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওয়েবসাইটে হাজির হল প্রশ্ন।
কবে হাতে পাব কোয়ান্টাম আইপ্যাড?
নোবেল কমিটির ওয়েবসাইটে উঠে আসা সাধারণ মানুষের ওই জিজ্ঞাসাই জানিয়ে দিল পদার্থবিদ্যায় এ বছরের নোবেল পুরস্কারের গুরুত্ব।
ফরাসি বিজ্ঞানী সের্জ আরশ এবং আমেরিকার ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড যে কৃতিত্বের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত পুরস্কারে এ বার ভূষিত হচ্ছেন, তা শেষতম বিপ্লব আনবে কম্পিউটার বিজ্ঞানে। ওঁদের গবেষণার সূত্রে এক দিন তৈরি হবে এমন কম্পিউটার, যা আজকের পিসি-ল্যাপটপ-আইপ্যাডের তুলনায় হবে লক্ষ কোটি গুণ ক্ষমতাবান। যাদের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান তথ্য-প্রযুক্তির যন্ত্র হবে না আর কোনও কিছু। তাই এটাই হবে সর্বশেষ বা চূড়ান্ত তথ্য-প্রযুক্তি বিপ্লব।
রয়াল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস-এর ঘোষণায় মঙ্গলবার বলা হয়েছে, আরশ এবং ওয়াইনল্যান্ড পুরস্কৃত হচ্ছেন “কোয়ান্টাম বস্তু মাপা কিংবা নাড়াচাড়া করার উপযোগী অভাবনীয় পদ্ধতি আবিষ্কারের জন্য।”
কোয়ান্টাম বস্তু জিনিসটা কী?
তা হল অণু-পরমাণু কিংবা তাদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা। নামের আগে ‘কোয়ান্টাম’ বিশেষণটি রয়েছে ওদের অদ্ভুতুড়ে চরিত্র বোঝাতে। ধরা যাক একটা খেলার বল। যা আকারে বড়, কিন্তু কোয়ান্টাম বস্তু নয়। তাই তা থাকতে পারে হয় এখানে, নয় ওখানে। কিন্তু বস্তুকণা ইলেকট্রন, কিংবা আলোর কণা ফোটন, এরা কোয়ান্টাম চরিত্রের। তাই তারা একই মুহূর্তে থাকতে পারে এখানে এবং ওখানে। হ্যাঁ, একই সঙ্গে এখানে এবং ওখানে। এর চেয়ে অদ্ভুতড়ে কিছু হয় কি? ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাদের এমন আজব কোয়ান্টাম চরিত্রের কথা শুনেই গোটা কোয়ান্টাম শাস্ত্রটাকে উপেক্ষা করেছিলেন স্বয়ং অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। মানতে পারেননি। আর বিজ্ঞানী নিলস বোর, যাঁর সঙ্গে এ ব্যাপারে তিনি তর্ক করে গিয়েছেন সারা জীবন, তিনি বলতেন, “কোয়ান্টামে যে ভ্যাবাচাকা খাবে না, সে বুঝবে না এর কিছুই।” |
|
|
সের্জ আরশ
| ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড |
|
আইনস্টাইন না মানুন, তবু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাদের কোয়ান্টাম চরিত্র কিন্তু মিথ্যে নয়। বারবার পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে কণাদের ওই অদ্ভুতড়ে দশা। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে যিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, সেই আরউইন শ্রোয়েডিংগার কোয়ান্টামের ওই অদ্ভুতড়ে কাণ্ডকারখানা বোঝাতে আস্ত একখানা কাল্পনিক পরীক্ষার বর্ণনা দিয়েছিলেন। যে পরীক্ষা অনুযায়ী, ডালাবন্ধ একটা বাক্সের মধ্যে একটা বেড়াল থাকতে পারে একই সঙ্গে জীবিত এবং মৃত অবস্থায়। কোয়ান্টাম কণা যদি থাকতে পারে এখানে এবং ওখানে, তা হলে বেড়ালের একই সঙ্গে জ্যান্ত এবং মরা অবস্থায় থাকতেই বা দোষ কী? তা হলে এক সঙ্গে একই বেড়ালকে অমন দু’দশায় আমরা দেখি না কেন? কেন বাক্সের ডালা খুললে দেখি, হয় জ্যান্ত, না হয় মৃত বেড়াল? এর উত্তরও দিয়েছে কোয়ান্টাম শাস্ত্র। বলেছে, ‘দেখা’ হল পরিবেশের সঙ্গে সঙ্ঘাত বা মোলাকাত। বিজ্ঞানের নিয়মে এমন সঙ্ঘাত বা মোলাকাত হলেই বস্তু হারাবে তার কোয়ান্টাম চরিত্র। এক সঙ্গে একাধিক দশার বদলে, তা পাবে কোনও একটা দশা। সে জন্যই ডালা খুললে আমরা দেখব হয় জ্যান্ত, অথবা মৃত বেড়াল।
এ হেন নিয়ম-কানুনের জন্যই কোয়ান্টাম কণা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সাংঘাতিক কঠিন। পরিবেশের সামান্যতম ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে কণাদের কোয়ান্টাম ভেল্কি শনাক্ত করা খুব মুশকিল। সেই মুশকিল আসান করেছেন আরশ এবং ওয়াইনল্যান্ড। পরিবেশের প্রভাব বাঁচিয়ে সরাসরি লক্ষ করেছেন পরমাণু কিংবা আলোর কণা ফোটনের কোয়ান্টাম গুণাগুণ। ফরাসি নাগরিক আরশ কাজ করেছেন প্যারিসে কলেজ দ ফ্রঁস-এ তাঁর গবেষণাগারে। আর মার্কিন নাগরিক ওয়াইনল্যান্ড কলোরাডোর বোল্ডার শহরে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেকনোলজি ল্যাবরেটরিতে। ডালাবন্ধ বাক্সে বেড়ালের উদাহরণ টেনে বলতে হয় ওঁরা বুঝিয়েছেন, এই ‘দেখা’ কাজটা কী ভাবে এক সঙ্গে জীবিত ও মৃত বেড়ালটাকে আলাদা করে ফেলে, এবং আমরা দেখি জীবিত অথবা মৃত বেড়াল।
গবেষণা তো কোয়ান্টাম কণার চরিত্র হাতেনাতে ধরা নিয়ে। তাতে কম্পিউটার প্রযুক্তির লাভ? কেমন করে আরশ এবং ওয়াইনল্যান্ডের সাফল্য পথ দেখাবে অমিত ক্ষমতাবান পিসি-ল্যাপটপ-আইপ্যাড তৈরিতে?
প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে ওই কোয়ান্টাম চরিত্রে। আরশ এবং ওয়াইনল্যান্ড তৈরি করেছেন একই সঙ্গে দুই দশার পরমাণু কিংবা ফোটন কণা। এমন সাফল্য অবশ্যই প্রয়োগ করা যেতে পারে কম্পিউটারে। পিসি-ল্যাপটপ-আইপ্যাডের কাজের মূল নীতি জানলে এটা বোঝা যায়। ও সব কাজ করে সঙ্কেত নাড়াচাড়া করে। সঙ্কেত মূলত বিদ্যুৎপ্রবাহ। তা দু’রকম কারেন্ট ‘অন’ এবং ‘অফ’। সাধারণ পিসি-ল্যাপটপ-আইপ্যাড কাজ করে ওই ‘অন-অফ’ সম্বল করে। যাতে কোনও সার্কিট কখনও অন, কখনও অফ। কম্পিউটারের কী-বোর্ডে বা আইপ্যাডের স্ক্রিনে আঙুল চালানো থেকে শুরু করে মনিটরে লেখা ফুটে ওঠার মাঝের পথটুকুতেও রয়েছে অনেকগুলো অন-অফ। অর্থাৎ অনেকগুলো হোঁচট। তাই আপাত ভাবে কাজটা সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ে হলেও একটা জায়গায় গিয়ে সাধারণ পিসি-ল্যাপটপ-আইপ্যাডের ক্ষমতা সীমিত। সেই কারণেই কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত বিজ্ঞানীরা। কোয়ান্টাম-নির্ভর নতুন দিনের কম্পিউটার সেই চিন্তাই দূর করবে। কারণ তাতে কারেন্ট কখনও অন, কখনও অফ নয়। বরং একই সঙ্গে জীবিত ও মৃত বেড়ালের কায়দায় তা থাকবে একই সঙ্গে অন এবং অফ! কাজেই পথ চলা হবে অত্যন্ত দ্রুত। এবং এ হেন যন্ত্রগুলো হবে এখনকার তুলনায় লক্ষ কোটি গুণ বেশি ক্ষমতাবান।
শুধু অমিত ক্ষমতাবান কম্পিউটারই নয়, প্রায় নির্ভুল ঘড়িও বানাতে সাহায্য করবে আরশ এবং ওয়াইনল্যান্ডের গবেষণা। কেমন নিখুত ঘড়ি? নোবেল কমিটির তরফে ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, তেমন ঘড়ি তৈরি হলে, ১৪০০ কোটি বছর আগে ব্রহ্মাণ্ডের জন্মের সময় থেকে আজ পর্যন্ত সময় মাপায় ভুলচুক হবে মাত্র কয়েক সেকেন্ড!
কোয়ান্টাম কণা নিয়ে এমন দুনিয়াজোড়া তোলপাড়ের দিনে অবশ্য আরও এক বার উঠছে ঈশ্বরকণা প্রসঙ্গ। অনেকেই আশা করেছিলেন, ঈশ্বরকণার অস্তিত্ব প্রমাণের মতো হাতে-গরম কীর্তিকে হয়তো এই বছরেই নোবেলে সম্মানিত করা হবে। তা ছাড়া হিগস্-বোসন কণার অন্যতম প্রবক্তা পিটার হিগসের বয়স এখন ৮৩। যে হেতু নোবেল পুরস্কার মরণোত্তর দেওয়া হয় না, তাই নোবেল কমিটি এই বছরেই প্রবীণ বিজ্ঞানীকে পুরস্কারটা দেবেন বলে আশা করছিলেন অনেকে। কিন্তু সমস্যা হল, পদার্থবিদ্যার ‘ঈশ্বরপ্রাপ্তি’তে হিগস্ ছাড়া আরও অন্তত ৭ বিজ্ঞানীর বড়সড় অবদান রয়েছে। নোবেলের নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর একই বিষয়ে সর্বোচ্চ তিন জন পুরস্কার পেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে হিগস্ ছাড়া আরও যে কোনও দু’জনকে বেছে নিতে হত। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বাকি ৫ জনের প্রতি অবিচারের অভিযোগ ওঠার একটা সম্ভাবনা ছিল। সম্ভবত এই বিতর্ক এড়াতেই নোবেল কমিটি এ যাত্রা ঈশ্বরকণা সংক্রান্ত সাফল্যকে পাশে সরিয়ে রাখল। তবে ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকের যে সাফল্যকে এ দিন পুরস্কৃত করা হল, তার নোবেলপ্রাপ্তি সম্পর্কেও নিশ্চিত ছিলেন বহু বিজ্ঞানী।
পুরস্কারে অভিভূত আরশ। ভিডিও-যোগাযোগে বলেছেন, “হাঁটছিলাম রাস্তা দিয়ে, একটা বেঞ্চের পাশ দিয়ে। (নোবেল কমিটির ফোন পেয়ে) বসে পড়ি সঙ্গে সঙ্গে। আমার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী। মোবাইলে দেখলাম সুইডেনের এরিয়া কোড। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি ব্যাপারটা কী। আজ শ্যাম্পেন নিয়ে বসব।” |